Thursday, November 20, 2025
spot_img
Homeভ্রমণ টুকিটাকি২০০০ কিলোমিটারের শ্বাসরুদ্ধকর ট্রেনযাত্রা: ছুঁয়ে গেলাম বিশ্বের সর্বোচ্চ রেলস্টেশন

২০০০ কিলোমিটারের শ্বাসরুদ্ধকর ট্রেনযাত্রা: ছুঁয়ে গেলাম বিশ্বের সর্বোচ্চ রেলস্টেশন

চীনের জিনিং থেকে তিব্বতের লাসা—প্রায় দুই হাজার কিলোমিটারের দীর্ঘ রেলপথ। পুরো যাত্রায় কখনো সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ১৬ হাজার ফুটেরও বেশি উচ্চতায় উঠেছে ট্রেন, কখনো পেরিয়ে গেছে শত শত টানেল, বরফঢাকা মালভূমি আর গিরিপথ। সেই দীর্ঘ ভ্রমণের অভিজ্ঞতা ভাগ করে নিচ্ছেন এক ভ্রমণকারী।

ঢাকা থেকে প্রথমে কুনমিং, সেখানেই এক রাত থেকে পরদিন সকালে উড়োজাহাজে পৌঁছানো হয় জিনিং শহরে। বিমানবন্দর থেকে সোজা রেলস্টেশনে যেতে হয়, যেখানে তিব্বতে প্রবেশের বিশেষ পারমিট যাচাই করা হয়। অপেক্ষা করতে করতে চারপাশের বিশাল স্টেশন চত্ত্বর চোখে পড়ে—পরিচ্ছন্ন, প্রশস্ত, আর খাবারের নানা দোকানে সরগরম। ট্রেনে খাবারের বিকল্প কম, তাই অনেকেই আগেভাগে শুকনো খাবার সংগ্রহ করছিলেন। খেজুর, চকোলেট, বাদাম থেকে শুরু করে পাউরুটি ও ফল—যাত্রীদের প্রস্তুতি দেখা যাচ্ছিল স্পষ্টই।

বোর্ডে ঘোষণা এল, লাসাগামী ট্রেন প্ল্যাটফর্মে পৌঁছেছে। নেমে দেখা গেল জনশূন্য প্ল্যাটফর্মে প্রতিটি কামরার সামনে দাঁড়িয়ে আছেন একজন করে গার্ড, সবাই ইউনিফর্ম পরিহিত ও কঠোর শৃঙ্খলাবদ্ধ। আমাদের নির্দিষ্ট কোচে দায়িত্বে ছিলেন এক নারী গার্ড, যিনি পারমিট ও ভ্রমণ নথিপত্র যাচাই করে ভেতরে প্রবেশে অনুমতি দিলেন। প্রতিটি কোচে চারজনের শোবার ব্যবস্থা—দুটি উপরে ও দুটি নিচে—তবে মালপত্র রাখার জায়গা বেশ কম, যা উচ্চতার রেলপথ বিবেচনায় গ্রহণ করতেই হয়।

দু’টি ভ্রমণদল একসঙ্গে যাত্রা করছিল—একটিতে সাতজন, অন্যটিতে পনেরো। ট্রেন ছাড়তেই ধীর গতিতে এগোতে থাকে, আর শুরু হয় টানেলে ঢোকার পর টানেল পেরোনোর দীর্ঘ অভিজ্ঞতা। মাত্র বিশ মিনিটের মাথায় পাঁচটি বড় টানেল অতিক্রম করে ট্রেন। কখনো গতি বাড়ে, কখনো কমে—গতি কমলেই মনে হয় ট্রেন আরো উঁচুতে উঠছে।

জানালার বাইরে দৃশ্যপট ক্রমাগত বদলে যাচ্ছে—কখনো ধূসর পর্বত, কখনো ঘাসে ভরা তৃণভূমি, কখনো বা সম্পূর্ণ গাছহীন পাহাড়। কোথাও রঙ লালাভ, কোথাও হলুদাভের ছোঁয়া। বরফঢাকা শৃঙ্গ, গলিত হিমবাহ থেকে নেমে আসা স্বচ্ছ জলের ধারা, আর দূরে চরতে থাকা ইয়াক—সব মিলিয়ে প্রকৃতির এক অনন্য রূপ। ক্যামেরায় বন্দী করার আগেই অনেক দৃশ্য মিলিয়ে যাচ্ছিল দ্রুত।

অন্ধকার নামতেই সবাই রাতের খাবারের প্রস্তুতি নিল। যেটুকু সঙ্গে ছিল ভাগাভাগি করে খাওয়া হলো। খেয়ে শুয়ে পড়তেই উচ্চতার কারণে শ্বাসকষ্ট ও মাথাব্যথা অনুভূত হলো, যা এ অঞ্চলে খুবই স্বাভাবিক। ট্রেনে কৃত্রিম অক্সিজেনের ব্যবস্থা থাকলেও প্রয়োজন হলো না। কিছুক্ষণ পরই স্বাভাবিক হয়ে আসে শ্বাসপ্রশ্বাস।

রাত তিনটায় ঘুম ভেঙে দেখা গেল ট্রেন থেমে আছে টাংগুলা স্টেশনে—সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে প্রায় ১৬ হাজার ৬০০ ফুট উঁচুতে অবস্থিত বিশ্বের সবচেয়ে উঁচু রেলস্টেশন। উজ্জ্বল আলোয় ঝলমল করা স্টেশনটি দেখতে পেলেও কামরা থেকে নামা গেল না, কারণ ওপরে থাকা বিছানায় ওঠানামা করা ঝামেলাজনক ছিল। স্টেশনে কর্মচারী থাকে কি না, সে বিষয়ে নিশ্চিত হওয়া যায়নি।

ভোরে আবার পাহাড়ি দৃশ্যপট চোখে পড়ে। কাছাকাছি ছোট ছোট গ্রাম, একই নকশার বাড়িঘর, আর মাঝেমধ্যে বিস্তীর্ণ মালভূমি। পরে ‘ইয়াং বা জিং’ নামের আরেক স্টেশনে থামে ট্রেন—এটির উচ্চতাও ৪৩০০ মিটারের বেশি।

দুপুরে খাবারের কামরায় গিয়ে খাবার অর্ডার করা হলো—ভাত, সবজি, মুরগি ও মাছ। কিছুক্ষণ পর জানালা দিয়ে প্রথম আধুনিক দালান দেখা যায়, তখনই বুঝা যায় লাসা আর দূরে নেই।

জিনিং থেকে লাসা পৌঁছাতে সময় লাগল প্রায় সাড়ে ২১ ঘণ্টা। এ পথে প্রায় ৭০০ টানেল অতিক্রম করেছে ট্রেন। এর মধ্যে কিছু টানেল ১০ কিলোমিটারেরও বেশি দীর্ঘ। বিশ্বের সর্বোচ্চ রেল টানেল—ফেঙ্গুওশান টানেল—যার উচ্চতা প্রায় ৪৯০০ মিটার, সেটিও অতিক্রম করা হয়েছে এ পথেই।

লাসা রেলস্টেশনে নামতেই স্থানীয় ট্যুর পরিচালকের পক্ষ থেকে উত্তরীয় পরিয়ে স্বাগত জানানো হয়। প্রবেশ করতেই শহরটি পরিচ্ছন্ন, শান্ত ও সুশৃঙ্খল বলে অনুভূত হয়।

RELATED ARTICLES

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

- Advertisment -
Google search engine

Most Popular

Recent Comments