একই দৃশ্য যেন বারবার ফিরে আসছে, আর বার্তাটিও ক্রমেই স্পষ্ট হচ্ছে—ফুটবল এখন নিজেই খেলোয়াড়দের শত্রু হয়ে উঠছে! আধুনিক ফুটবলে অতিরিক্ত ম্যাচ খেলার চাপে প্রতিনিয়ত ক্লান্ত, অবসন্ন ও চোটে জর্জরিত হয়ে পড়ছেন তারকারা। সর্বশেষ সতর্কবার্তা এসেছে তরুণ প্রতিভা ইয়ামালের কাছ থেকে।
গত মাসে জাতীয় দলের অনুশীলনের সময় চোট পান এই তরুণ উইঙ্গার। এরপর থেকেই ক্লাব ও জাতীয় দলের মধ্যে শুরু হয় দোষারোপের পালা। ক্লাব কোচ ক্ষোভ ঝেড়ে বলেন, “সে ব্যথা নিয়েই জাতীয় দলে গেছে, খেলেছেও—এটা খেলোয়াড়দের যত্ন নেওয়া নয়।” অপরদিকে জাতীয় দলের কোচ পাল্টা জবাবে দলের চিকিৎসা ব্যবস্থাকে রক্ষা করেন। কিন্তু বাস্তবতা হলো, ইয়ামাল এখন অন্তত তিন সপ্তাহের জন্য মাঠের বাইরে।
এই ঘটনাটি ফুটবলের ভেতরের এক গভীর সংকটের প্রতিফলন। অতিরিক্ত ম্যাচ খেলার চাপে ফুটবলাররা যেন ধীরে ধীরে নিজেদের শেষ করে ফেলছেন। আন্তর্জাতিক ফুটবলার ইউনিয়ন ফিফপ্রোর সাম্প্রতিক প্রতিবেদনে উঠে এসেছে এক ভয়াবহ বাস্তবতা—তরুণ প্রজন্মের খেলোয়াড়রা আগের প্রজন্মের তুলনায় প্রায় দ্বিগুণ সময় মাঠে কাটাচ্ছেন।
মাত্র ১৮ বছর বয়সেই ইয়ামাল খেলেছেন ১৩০টি পেশাদার ম্যাচ, মোট সময় ৯,৭৭২ মিনিট। একই বয়সে ইনিয়েস্তা, জাভি বা ফ্যাব্রেগাসের চেয়ে প্রায় দ্বিগুণ! এমনকি জুড বেলিংহামের চেয়েও ৩১ শতাংশ বেশি সময় মাঠে ছিলেন তিনি। অন্যদিকে উরুগুয়ের মিডফিল্ডার ভালভের্দে খেলেছেন এক মৌসুমেই ৭২টি ম্যাচ, যার ৮১ শতাংশই টানা—দুই ম্যাচের মধ্যে পাঁচ দিনেরও কম বিশ্রাম পেয়েছেন। চিকিৎসকরা বলছেন, এমন ছন্দ বজায় রাখা শারীরিকভাবে প্রায় অসম্ভব।
একই বাস্তবতা দেখা যায় রদ্রির ক্ষেত্রেও। ২০২২ থেকে ২০২৪ সালের মধ্যে তিনি খেলেছেন ১৩৫টি ম্যাচ, যা বিশেষজ্ঞদের সুপারিশকৃত সীমার দ্বিগুণেরও বেশি। টানা খেলতে খেলতে শেষ পর্যন্ত হ্যামস্ট্রিং ও হাঁটুর চোটে দীর্ঘদিন মাঠের বাইরে থাকতে হয়েছে তাঁকে। ক্লাব কোচরাও এখন এ নিয়ে উদ্বিগ্ন, কারণ অতিরিক্ত ম্যাচ মানেই বাড়ছে দুর্ঘটনার ঝুঁকি।
২২ বছর বয়সী পেদ্রিও একই চক্রে আটকে গেছেন। তিনি খেলেছেন এক মৌসুমে ৬৯ ম্যাচ, যার বেশির ভাগই পর্যাপ্ত বিশ্রাম ছাড়াই। এমনকি বায়ার্নের কিম মিন-জে ৭৩ দিনে ২০টি ম্যাচ খেলেছেন, গড়ে প্রতি ৩.৬ দিনে একটি করে ম্যাচ। অভিজ্ঞ মদরিচও ৩৯ বছর বয়সে ৭৬ ম্যাচে ৪,৩৭৬ মিনিট মাঠে ছিলেন। এমন পরিস্থিতিতে বার্সেলোনার এক ডিফেন্ডার বলেন, “যখন ম্যাচ এত বেশি হয়, তখন খেলা জীবন হয়ে যায়। কিন্তু অতিরিক্ত ব্যবহারে খেলার প্রতি আগ্রহও হারিয়ে যায়।”
ফিফপ্রোর জরিপে দেখা গেছে, মৌসুম শেষে খেলোয়াড়দের অন্তত ২৮ দিনের পূর্ণ বিশ্রাম দরকার। কিন্তু ইউরো ২০২৪ শেষে মাত্র ১৪ শতাংশ খেলোয়াড় সেই বিশ্রাম পেয়েছেন। কোপা আমেরিকার পর সংখ্যা আরও কমে ৯ শতাংশে নেমেছে। লিভারপুলের এক গোলরক্ষক বলেন, “নতুন টুর্নামেন্ট যোগ করা হয়, কিন্তু কেউই আমাদের মতামত জানতে চায় না। আমরা ক্লান্ত।”
বর্তমান ফুটবল ক্যালেন্ডার এখন এক জটিল গোলকধাঁধা। ফিফা ক্লাব বিশ্বকাপের নতুন সূচি, ইউরোপীয় টুর্নামেন্ট, এবং দেশীয় লিগ মিলিয়ে কোনো দলই যথাযথ বিশ্রাম পাচ্ছে না। ইউরোপের বড় দলগুলো গ্রীষ্মকালীন বিরতিতে পেয়েছে মাত্র ৭–৮ দিনের বিশ্রাম। অথচ অন্যান্য খেলার তুলনায় এই পার্থক্য ভয়াবহ—এনবিএ খেলোয়াড়রা ফাইনালের পর বিশ্রাম পান প্রায় ২৩ সপ্তাহ, বেসবল খেলোয়াড়রা ১৫ সপ্তাহ পর্যন্ত।
অতিরিক্ত ভ্রমণচাপও এখন বড় সমস্যা। এক গোলরক্ষক এক মৌসুমে ভ্রমণ করেছেন ১,৬৯,০০০ কিলোমিটার, বিমানে কাটিয়েছেন ২১৭ ঘণ্টা। কেউ কেউ ১৪ দিনের মধ্যে দুটি মহাদেশে চারটি ম্যাচ খেলেছেন।
বিশেষজ্ঞদের মতে, সমাধান একটাই—বাধ্যতামূলক চার সপ্তাহের বিশ্রাম, ধীরগতির প্রাক্-মৌসুম, ম্যাচের মাঝে অন্তত দুই দিন বিরতি এবং তরুণ খেলোয়াড়দের জন্য বিশেষ সুরক্ষা। কিন্তু বাস্তবে কেউই তা প্রয়োগ করছে না। ফিফা, উয়েফা, লিগ, এবং ফেডারেশন—সবাই নিজেদের স্বার্থে সূচি বাড়াচ্ছে।
ফলে সর্বোচ্চ মূল্য দিতে হচ্ছে খেলোয়াড়দেরই। কিংবদন্তি এক কোচ একবার বলেছিলেন, “অতিরিক্ত ম্যাচ ও ভ্রমণের প্রভাব উপেক্ষা করলে যেকোনো খেলোয়াড়ই একসময় চোটে পড়বে।” ইয়ামালের ঘটনাই যেন সেই সতর্কবার্তার জীবন্ত প্রমাণ।



