যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্টের সরকারি বাসভবন—‘হোয়াইট হাউস’। এটি কেবল একটি আবাসস্থল নয়, বরং নেতৃত্ব, গণতন্ত্র ও ক্ষমতার প্রতীক হিসেবে বিশ্বের ইতিহাসে বিশেষ স্থান দখল করে আছে। প্রায় আড়াই শতাব্দীর ইতিহাসে ভবনটি দেখেছে ক্ষমতার পালাবদল, যুদ্ধ, শান্তিচুক্তি ও বহু ঐতিহাসিক মুহূর্ত।
সময় বদলেছে, প্রেসিডেন্ট পরিবর্তন হয়েছে—কিন্তু শ্বেতবর্ণ ভবনটি নীরবে ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। যুক্তরাষ্ট্রের পরাশক্তি হয়ে ওঠার সঙ্গে সঙ্গে এ ভবন বিশ্বনেতৃত্বের প্রতীক হিসেবেও নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছে।
নতুন রাজধানী গড়ার উদ্যোগ
১৭৯২ সালের ১৩ অক্টোবর শুরু হয় মার্কিন প্রেসিডেন্টের সরকারি আবাসস্থল নির্মাণকাজ। তৎকালীন প্রেসিডেন্টের প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধানে রাজধানী গড়ে তোলা হয় পটোম্যাক নদীর তীরে। নতুন শহরের পরিকল্পনা করেন এক ফরাসি–আমেরিকান স্থপতি ও নগর পরিকল্পনাবিদ। সেই শহরের নাম দেওয়া হয় প্রেসিডেন্টের নামে—ওয়াশিংটন ডিসি।
নতুন রাজধানীতে প্রেসিডেন্টের জন্য একটি মহৎ আবাস গড়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। সেই অনুযায়ী ১৭৯১ সালে বর্তমান ১৬০০ পেনসিলভানিয়া অ্যাভিনিউতে জায়গা নির্ধারণ করা হয়। নির্বাচিত স্থানের বিশেষত্ব ছিল, এখান থেকে সরাসরি পার্লামেন্ট ভবন ‘ক্যাপিটল হিল’-এর সঙ্গে সংযোগ স্থাপন করা যায়।
নকশা প্রতিযোগিতা ও নির্মাণ
প্রেসিডেন্ট ভবনের জন্য শুরু হয় নকশা আহ্বান। প্রতিযোগিতায় নয়জন স্থপতি অংশ নেন। শেষ পর্যন্ত আইরিশ বংশোদ্ভূত এক আমেরিকান স্থপতির নকশা নির্বাচিত হয়, যিনি পরবর্তীতে এই ভবনের নান্দনিক নির্মাণের জন্য স্বর্ণপদক পান।
প্রায় আট বছর ধরে চলে নির্মাণকাজ, যা শেষ হয় ১৮০০ সালের ১ নভেম্বর। যদিও কিছু ছোটখাটো কাজ তখনও চলমান ছিল। ভবনের অন্যতম পরিকল্পনাকারী প্রেসিডেন্ট জীবিত থাকলেও শেষ পর্যন্ত তিনি এই ভবনে থাকার সৌভাগ্য পাননি। নির্মাণ শেষ হওয়ার আগেই তিনি মৃত্যুবরণ করেন।
প্রথম প্রেসিডেন্ট হিসেবে সেখানে বসবাস শুরু করেন তাঁর উত্তরসূরি প্রেসিডেন্ট অ্যাডামস ও ফার্স্ট লেডি অ্যাডামস। এরপর থেকে প্রায় প্রতিটি মার্কিন প্রেসিডেন্টের সরকারি আবাসস্থল হয়ে উঠেছে এই শ্বেত ভবন।
কাঠামো ও বৈশিষ্ট্য
ছয়তলা এই ভবনে রয়েছে ১৩২টি কক্ষ, ৩৫টি বাথরুম, ৪১২টি দরজা ও ১৪৭টি জানালা। ভবনের তিনটি মূল অংশ—ওয়েস্ট উইং, ইস্ট উইং ও এক্সিকিউটিভ রেসিডেন্স। প্রেসিডেন্টের অফিস হিসেবে ব্যবহৃত ওভাল অফিস এই ভবনেই অবস্থিত।
রান্নাঘরটি একসঙ্গে ১৪০ জন অতিথির খাবার প্রস্তুত করতে সক্ষম। বলা হয়ে থাকে, বাইরের অংশে রঙ করতে লাগে প্রায় ৫৭০ গ্যালন সাদা রং। এছাড়া দুটি সুইমিং পুল, থিয়েটার, টেনিস কোর্ট, গলফ কোর্ট ও জগিং ট্র্যাকও আছে।
১৮৯১ সালে প্রথমবারের মতো এখানে বিদ্যুৎ সংযোগ দেওয়া হয়, যা সেই সময়ের জন্য ছিল যুগান্তকারী উদ্যোগ।
আগুনে ধ্বংস ও পুনর্জন্ম
হোয়াইট হাউস দু’বার বড় ধরনের অগ্নিকাণ্ডের মুখে পড়ে। প্রথমবার ১৮১৪ সালের আগস্টে, যখন ব্রিটিশ সেনারা আগুন লাগায়। দ্বিতীয়বার ১৯২৯ সালে বড়দিনের সময় ওয়েস্ট উইংয়ে আগুন লাগে। দু’বারই ভবনটি ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত হয়, এবং উভয় সময়ই বড় সংস্কার করতে হয়।
প্রথম সংস্কারের দায়িত্ব নেন ভবনের মূল স্থপতিই। পরে সময় ও প্রেসিডেন্টদের রুচি অনুযায়ী বেশ কয়েকবার অভ্যন্তরীণ সাজসজ্জা ও কাঠামোতে পরিবর্তন আনা হয়। যুক্ত হয়েছে নতুন দপ্তর, বাগান ও পাঠাগার।
তবে যত পরিবর্তনই হোক, ভবনের বাহ্যিক শ্বেতশুভ্র রূপ অপরিবর্তিত থেকেছে। এই শুভ্র রঙই ভবনটির নামের উৎস—‘হোয়াইট হাউস’। আগুনে পুড়ে যাওয়ার পর নতুন করে রঙ করা হয় সাদা, আর সেই থেকেই এই নামটি জনপ্রিয় হয়ে ওঠে।
আজও এটি শুধু একটি ভবন নয়, বরং আমেরিকান গণতন্ত্র ও নেতৃত্বের দৃঢ় প্রতীক—যে স্থানে গৃহীত হয় বিশ্বের গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত, আর ইতিহাসে লেখা হয় নতুন অধ্যায়।



