Thursday, November 20, 2025
spot_img
Homeসম্পাদকীয়হাইব্রিড গাড়ি: লাভজনক হলেও পরিবেশবান্ধব নয়

হাইব্রিড গাড়ি: লাভজনক হলেও পরিবেশবান্ধব নয়

দুই দশক আগেও বৈদ্যুতিক গাড়িকে ভবিষ্যতের কল্পনা বলা হতো। কিন্তু সময় বদলেছে, প্রযুক্তির উন্নতি ঘটেছে, ব্যাটারির কার্যক্ষমতা বেড়েছে, আর এখন ইলেকট্রিক গাড়ি সাধারণ মানুষের নাগালের মধ্যেই এসেছে। তবুও, সাম্প্রতিক গবেষণায় দেখা যাচ্ছে—যে হাইব্রিড গাড়িগুলোকে পরিবেশবান্ধব বিকল্প হিসেবে প্রচার করা হচ্ছিল, বাস্তবে সেগুলো ততটা “সবুজ” নয়।

ইউরোপের এক পরিবহনবিষয়ক সংস্থা সম্প্রতি জানিয়েছে, প্লাগ-ইন হাইব্রিড গাড়ি (PHEV) বাস্তবে পেট্রোল ও ডিজেল গাড়ির তুলনায় মাত্র ১৯% কম কার্বন নিঃসরণ করে। অথচ ল্যাবরেটরিতে দাবি করা হয়েছিল, এসব গাড়ি ৭৫% পর্যন্ত কম দূষণ ঘটায়। এর ফলে স্পষ্ট হয়ে গেছে—যে ধারণা দেওয়া হয়েছিল যে শহরের ছোট যাত্রায় ব্যাটারির শক্তি ব্যবহার করা যাবে আর দীর্ঘ যাত্রায় পেট্রোল, সেটি কেবলই একটি আকর্ষণীয় বিপণন কৌশল।

তবে হাইব্রিড গাড়ি নির্মাতাদের জন্য ভীষণ লাভজনক ব্যবসা। কারণ, তারা মূলত প্রচলিত পেট্রোল গাড়িতেই কিছু প্রযুক্তিগত সংযোজন করে নতুন পণ্য হিসেবে বাজারে ছাড়ছে এবং উচ্চমূল্যে বিক্রি করছে। সরকারের পক্ষ থেকেও এসব গাড়ি প্রণোদনা পাচ্ছে, ফলে নির্মাতারা আরও উৎসাহী হচ্ছে। এতে পরিবেশের চেয়ে মুনাফার দিকটাই বেশি গুরুত্ব পাচ্ছে।

ইউরোপীয় অটোমোবাইল শিল্প এখন এক ধরনের দ্বন্দ্বের মধ্যে রয়েছে—একদিকে জলবায়ু রক্ষার প্রয়োজন, অন্যদিকে রয়েছে ব্যবসায়িক বাস্তবতা ও রাজনৈতিক প্রভাব। সাম্প্রতিক প্রতিবেদনে দেখা গেছে, চারটি বড় ইউরোপীয় গাড়ি কোম্পানি প্রকৃত নির্গমন তথ্যের ভিত্তিতে নয়, বরং ল্যাবরেটরি ফলাফলের ওপর নির্ভর করে প্রায় ৫ বিলিয়ন ইউরো জরিমানা এড়িয়েছে। অথচ বৈদ্যুতিক গাড়িতে দ্রুত রূপান্তরই এখন সময়ের দাবি।

তবে শিল্পের ভেতর থেকেই উঠে আসছে ভিন্ন মত। ইউরোপের একজন শীর্ষ নির্বাহী সম্প্রতি বলেছেন, আগামী ২০ বছরের আগে ইউরোপে বৈদ্যুতিক গাড়ি প্রধান প্রযুক্তি হয়ে উঠবে না। এর পেছনে ক্রেতার আগ্রহের অভাবই নয়, বরং উৎপাদন খরচ ও মুনাফা ধরে রাখার কৌশলও দায়ী। কারণ, হাইব্রিড ও পেট্রোলচালিত গাড়ি বিক্রি করেই নির্মাতারা এখনো বিপুল অর্থ আয় করছে।

এই সুযোগে নতুন প্রতিদ্বন্দ্বীরাও এগিয়ে আসছে। চীনের বৈদ্যুতিক গাড়ি নির্মাতা প্রতিষ্ঠান বিওয়াইডি (BYD) এখন যুক্তরাজ্যের বৃহত্তম বৈদ্যুতিক গাড়ির বাজারে পরিণত হয়েছে। এমনকি তারা সরকারের নতুন ভর্তুকি নীতির বাইরে থেকেও এই সাফল্য অর্জন করেছে, যেখানে চীনা গাড়ি পরিবেশগত কারণে বাদ পড়েছে। ইউরোপে আবার একদা জনপ্রিয় টেসলা ব্র্যান্ডের প্রতি ক্রেতাদের অনীহা তৈরি হয়েছে রাজনৈতিক বিতর্কের কারণে, ফলে সস্তা চীনা বৈদ্যুতিক গাড়িগুলোর সঙ্গে প্রতিযোগিতা আরও কঠিন হয়ে উঠছে।

তবুও, বাজারের এই খেলায় নতুন বাঁক আসতে পারে। কারণ, টয়োটা ২০২৭ সালের মধ্যে বাণিজ্যিকভাবে সলিড-স্টেট ব্যাটারি উৎপাদনের ঘোষণা দিয়েছে। এই প্রযুক্তি সফল হলে গাড়ি হবে আরও নিরাপদ, দ্রুত চার্জযোগ্য ও দীর্ঘপথে সক্ষম। একবার চার্জে লন্ডন থেকে মিলান পর্যন্ত যাত্রা তখন আর স্বপ্ন থাকবে না।

তবে প্রশ্ন হচ্ছে—এই পরিবর্তনের আসল লাভ কারা পাবে? বাজারের নিয়ম অনুযায়ী পুরস্কার সবসময় মুনাফা কেন্দ্রিক, টেকসই বা ন্যায্য নয়। তাই নতুন প্রযুক্তি এলেও তা কতটা সমাজের উপকারে আসবে, সেটাই ভাবনার বিষয়।

সবশেষে মূল প্রশ্নটি থেকেই যায়—গাড়ি, যতই কম দূষণ ঘটাক না কেন, কি আমাদের পরিবহন ব্যবস্থার কেন্দ্রবিন্দু হওয়া উচিত? শুধুমাত্র বৈদ্যুতিক গাড়ির ওপর নির্ভরতা ভবিষ্যতে আরও যানজট, দুর্ঘটনা ও সম্পদ অসমতার দিকে নিয়ে যেতে পারে। কারণ, উত্তর গোলার্ধের ধনী দেশগুলো যদি বৈদ্যুতিক গাড়ির জন্য প্রয়োজনীয় খনিজ সম্পদ একচেটিয়া দখলে নেয়, তবে উৎপাদনকারী দেশগুলো পিছিয়ে পড়বে। টেকসই উন্নয়ন মানে শুধু পরিচ্ছন্ন গাড়ি নয়, বরং কম গাড়ি—আর নগরজীবনকে গণপরিবহননির্ভর করা। একমাত্র তবেই সম্ভব হবে বাস্তব অর্থে কার্বন-নির্ভর অর্থনীতি থেকে বেরিয়ে আসা।

RELATED ARTICLES

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

- Advertisment -
Google search engine

Most Popular

Recent Comments