স্পেনের অর্থনীতিতে সম্প্রতি দারুণ গতি দেখা দিয়েছে। পর্যটন, বৈদেশিক বিনিয়োগ ও অভিবাসনের সমন্বয়ে দেশটি ইউরোপের অন্যান্য দেশের তুলনায় এগিয়ে রয়েছে। দক্ষিণ ইউরোপীয় এই দেশটি এখনো ইউরো অঞ্চলের শীর্ষে অবস্থান করছে।
২০২৫ সালের জন্য স্পেনের বার্ষিক জিডিপি বৃদ্ধির পূর্বাভাস ২.৫ শতাংশ। অন্যদিকে, ফ্রান্স, জার্মানি ও ইতালির বৃদ্ধি হতে পারে যথাক্রমে ০.৬, ০.০ ও ০.৭ শতাংশ।
চলতি বছরের দ্বিতীয় ত্রৈমাসিকে স্পেনের জিডিপি প্রত্যাশার চেয়ে বেশি বৃদ্ধি পেয়েছে—০.৭ শতাংশ, যেখানে পূর্বাভাস ছিল ০.৬ শতাংশ। এটি আগের ত্রৈমাসিকের ০.৬ শতাংশ বৃদ্ধির তুলনায়ও বেশি। দেশের জাতীয় পরিসংখ্যান ইনস্টিটিউট এই তথ্য নিশ্চিত করেছে।
বহুমুখী অর্থনীতি
দেশটির অর্থমন্ত্রী সম্প্রতি জানিয়েছেন, দুই বছরের মধ্যে স্পেন জিডিপি প্রবৃদ্ধিতে উন্নত দেশগুলোর মধ্যে অগ্রণী হবে। তিনি বলেন, শুধুমাত্র পর্যটন নয়, অ-পর্যটন পরিষেবার ক্ষেত্রেও রপ্তানি বাড়ছে। তথ্যপ্রযুক্তি, আর্থিক ও নিরীক্ষা খাতে রপ্তানি আয় পর্যটনের চেয়ে বেশি—১০ হাজার কোটি ইউরো বনাম ৯,৪৯৫ কোটি ইউরো। এটি স্পেনের অর্থনীতির আধুনিকায়নের গুরুত্বপূর্ণ অংশ।
অর্থনীতির শক্তিশালী প্রবৃদ্ধির সত্ত্বেও দেশটি কিছু চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি। এর মধ্যে রয়েছে বেতন ও জীবনযাত্রার খরচে সামঞ্জস্য, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবিলা, রাজনৈতিক বিভাজন এবং তরুণদের সর্বোচ্চ কর্মসংস্থান নিশ্চিত করা।
দেশের প্রধান অর্থনীতিবিদ জানান, ২০২১ থেকে শ্রমশক্তির ৯০ শতাংশ বৃদ্ধি এসেছে অভিবাসন থেকে। এটি পরিষেবা খাত সম্প্রসারণে সহায়ক এবং শ্রম খরচ নিয়ন্ত্রণে রাখতে সাহায্য করছে। ফলে পরিষেবার দামও উচ্চ মূল্যস্ফীতির পরিবেশে তুলনামূলকভাবে নিয়ন্ত্রিত রয়েছে।
পর্যটনের অবদান
স্পেনের জিডিপিতে পর্যটনের অবদান প্রায় ১২ শতাংশ। মহামারির প্রভাব কমার সঙ্গে সঙ্গে পর্যটন খাতে ব্যয় বৃদ্ধি পেয়েছে, যা দেশকে পশ্চিম ইউরোপের তুলনায় লাভবান করেছে। তবে পর্যটকের ঢল নিয়ে স্থানীয়দের মাঝে মাঝে প্রতিক্রিয়াও দেখা যায়।
২০২৪ সালে পর্যটন খাতে প্রায় ৩০ লাখ মানুষ কাজ করেছে, যা ২০২৩ সালের তুলনায় ৯.৭ শতাংশ বেশি। এছাড়া, কাজের সৃষ্টিও অভিবাসনের ওপর নির্ভরশীল। যেখানে অন্যান্য ইউরোপীয় দেশ সীমান্ত বন্ধ করছে, সেখানে স্পেন আগামী তিন বছরে প্রায় ১০ লাখ অভিবাসী গ্রহণের পরিকল্পনা করছে।
দেশের প্রধান অর্থনীতিবিদ আরও জানান, গত বছর অভিবাসীদের বেশির ভাগ এসেছে দক্ষিণ ও লাতিন আমেরিকার দেশগুলো থেকে। যুক্তরাষ্ট্রে কঠোর অভিবাসন নীতির কারণে মানুষ বিকল্প খুঁজছে।
নেক্সট জেনারেশন ইউরোপিয়ান ফান্ড ও বিনিয়োগ
স্পেন ইউরোপীয় ইউনিয়নের নেক্সট জেনারেশন তহবিল থেকেও সহায়তা পাচ্ছে। এই তহবিল থেকে দেশটি ১৬,৩০০ কোটি ইউরো পেয়েছে। এর মধ্যে ৭০ শতাংশ অনুদান ইতিমধ্যেই বিতরণ হয়েছে। সরকার এই তহবিলকে পর্যটনবহির্ভূত খাত যেমন নবায়নযোগ্য শক্তি ও রপ্তানিতে বিনিয়োগের জন্য ব্যবহার করছে।
পরিবেশবান্ধব জ্বালানিতে বিনিয়োগের ফলে বিদ্যুতের খরচও কমেছে। ২০০০-এর দশকে নবায়নযোগ্য জ্বালানিতে শুরু করা বিনিয়োগের ফলে ইউরোপে জ্বালানি সংকটের প্রভাব স্পেনে তুলনামূলকভাবে কম পড়েছে।
বিদেশি বিনিয়োগ ও উৎপাদন
উৎপাদন খরচ কম হওয়ায় দেশটি বিদেশি বিনিয়োগকারীদের জন্য আকর্ষণীয় হয়ে উঠেছে। চীনের একটি কোম্পানি ২০২৪ সালে মাদ্রিদে ইউরোপীয় সদর দপ্তর খোলার পাশাপাশি সৌরশক্তি ব্যবহার করে বিদ্যুৎ উৎপাদন শুরু করেছে।
বৃহৎ অটোমোবাইল ও ব্যাটারি কোম্পানি দেশে ৪৩০ কোটি ডলার বিনিয়োগ করে লিথিয়াম আয়ন ফসফেট ব্যাটারি কারখানা তৈরি করবে। এছাড়া, প্রত্যক্ষ বিদেশি বিনিয়োগের প্রবাহ শক্তিশালী এবং স্পেন ইউরোপীয় ইউনিয়নের মধ্যে চতুর্থ আকর্ষণীয় দেশ।
বিশ্লেষকরা মনে করছেন, পর্যটন, বিনিয়োগ, অভিবাসন এবং পরিবেশবান্ধব জ্বালানি মিলিয়ে স্পেনের অর্থনীতি ইউরোপে শক্তিশালী ও ব্যতিক্রমী উদাহরণ হয়ে উঠেছে।