সুদানের একটি জাতিসংঘ শান্তিরক্ষী ঘাঁটিতে ভয়াবহ ড্রোন হামলার ঘটনায় আন্তর্জাতিক অঙ্গনে গভীর উদ্বেগ সৃষ্টি হয়েছে। এ হামলায় ছয়জন শান্তিরক্ষী নিহত হন, যাঁরা সবাই বাংলাদেশের নাগরিক। ঘটনার পরপরই তীব্র নিন্দা জানিয়ে বিবৃতি দিয়েছেন জাতিসংঘের মহাসচিব। তিনি এই হামলাকে নৃশংস ও অগ্রহণযোগ্য বলে উল্লেখ করেন এবং দায়ীদের জবাবদিহির আওতায় আনার আহ্বান জানান।
ঘটনাটি ঘটে সুদানের দক্ষিণ কোরদোফান অঞ্চলের কাদুগলি শহরে অবস্থিত জাতিসংঘ শান্তিরক্ষী বাহিনীর একটি লজিস্টিক ঘাঁটিতে। গত শনিবার সেখানে ড্রোনের মাধ্যমে আক্রমণ চালানো হয়। জাতিসংঘের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, হামলায় নিহত ছয় শান্তিরক্ষীর পাশাপাশি আরও আটজন আহত হয়েছেন। হতাহত সবাই বাংলাদেশ থেকে পাঠানো শান্তিরক্ষী, যাঁরা ইউএন ইন্টারিম সিকিউরিটি ফোর্স ফর আবেই মিশনের অধীনে দায়িত্ব পালন করছিলেন।
জাতিসংঘ মহাসচিব তাঁর বিবৃতিতে বলেন, শান্তিরক্ষীদের লক্ষ্য করে এ ধরনের হামলা আন্তর্জাতিক আইনের গুরুতর লঙ্ঘন এবং এটি যুদ্ধাপরাধ হিসেবে বিবেচিত হতে পারে। তিনি আরও বলেন, শান্তিরক্ষীদের ওপর আক্রমণ কখনোই গ্রহণযোগ্য নয় এবং এ ঘটনায় জড়িতদের অবশ্যই বিচারের মুখোমুখি হতে হবে। একই সঙ্গে তিনি সুদানের চলমান সংঘাত অবসানে অবিলম্বে যুদ্ধবিরতির আহ্বান জানান।
হামলার দায় নিয়ে সুদানের সেনাবাহিনী দেশটির আধা সামরিক বাহিনী র্যাপিড সাপোর্ট ফোর্সেসের দিকে আঙুল তুলেছে। সেনাবাহিনীর এক বিবৃতিতে বলা হয়, এ হামলা বিদ্রোহী মিলিশিয়া ও তাদের পৃষ্ঠপোষকদের ধ্বংসাত্মক কৌশলের প্রতিফলন। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সেনাবাহিনী একটি ভিডিও প্রকাশ করেছে, যেখানে একটি স্থাপনা থেকে ঘন কালো ধোঁয়া উঠতে দেখা যায়। তাদের দাবি, এটি জাতিসংঘের শান্তিরক্ষী স্থাপনা। তবে অভিযুক্ত আধা সামরিক বাহিনী এ বিষয়ে তাৎক্ষণিকভাবে কোনো মন্তব্য করেনি।
বাংলাদেশি শান্তিরক্ষীদের প্রাণহানির ঘটনায় শোক ও গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছে বাংলাদেশ সরকার। অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা এক বিবৃতিতে নিহতদের পরিবারের প্রতি সমবেদনা জানান এবং আহতদের দ্রুত আরোগ্য কামনা করেন। একই সঙ্গে তিনি জাতিসংঘ শান্তিরক্ষী বাহিনীর ওপর হামলার ঘটনাকে অগ্রহণযোগ্য বলে উল্লেখ করেন।
যে এলাকায় হামলাটি হয়েছে, সেই আবেই অঞ্চল দীর্ঘদিন ধরে সুদান ও দক্ষিণ সুদানের মধ্যে বিরোধপূর্ণ এলাকা হিসেবে পরিচিত। ২০১১ সালে দক্ষিণ সুদান স্বাধীনতা অর্জনের পর থেকেই এই তেলসমৃদ্ধ অঞ্চলকে ঘিরে উত্তেজনা বিরাজ করছে। দুই দেশের সীমান্তে অবস্থিত এ অঞ্চলকে বিশেষ প্রশাসনিক মর্যাদা দেওয়া হয়েছে এবং সেখানে শান্তি ও নিরাপত্তা বজায় রাখতে জাতিসংঘের শান্তিরক্ষা মিশন মোতায়েন রয়েছে।
সুদানে দুই বছরের বেশি সময় ধরে গৃহযুদ্ধ চলছে। দেশটির সেনাবাহিনী ও আধা সামরিক বাহিনীর মধ্যে ক্ষমতার দ্বন্দ্ব থেকে শুরু হওয়া এই সংঘাত রাজধানী খার্তুম ছাড়িয়ে বিভিন্ন অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়েছে। মানবাধিকার সংস্থাগুলোর তথ্যমতে, এ সংঘাতে এখন পর্যন্ত ৪০ হাজারের বেশি মানুষ নিহত হয়েছেন। তবে বাস্তবে মৃতের সংখ্যা আরও বেশি হতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। এই যুদ্ধ ইতোমধ্যে বিশ্বের অন্যতম ভয়াবহ মানবিক সংকটে রূপ নিয়েছে এবং দেশের কয়েকটি অঞ্চলকে দুর্ভিক্ষের মুখে ঠেলে দিয়েছে।
সাম্প্রতিক সময়ে কোরদোফান অঞ্চলকে ঘিরে সংঘর্ষ আরও তীব্র হয়েছে, বিশেষ করে এল ফাশের এলাকার নিয়ন্ত্রণ পরিবর্তনের পর। পশ্চিম দারফুরে এটি ছিল সেনাবাহিনীর অন্যতম শেষ শক্ত ঘাঁটি। এই প্রেক্ষাপটে শান্তিরক্ষীদের ওপর হামলার ঘটনা পরিস্থিতিকে আরও জটিল করে তুলেছে।
উল্লেখযোগ্য বিষয় হলো, এই হামলার মাত্র এক মাস আগেই জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদ ইউএন ইন্টারিম সিকিউরিটি ফোর্স ফর আবেই শান্তিরক্ষা মিশনের মেয়াদ আরও এক বছরের জন্য নবায়নের সিদ্ধান্ত নেয়। বিশ্বের বিভিন্ন সংঘাতপূর্ণ অঞ্চলে জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা কার্যক্রমে বাংলাদেশ অন্যতম প্রধান অবদানকারী দেশ হিসেবে পরিচিত। দীর্ঘদিন ধরে বাংলাদেশি সেনাসদস্যরা আবেইসহ বিভিন্ন এলাকায় শান্তি প্রতিষ্ঠায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখে চলেছেন।



