বিশ্বজুড়ে এমন কিছু স্থান রয়েছে, যা প্রকৃতির আশ্চর্য সৌন্দর্য ও বিস্ময়ের প্রতীক। কানাডার ‘বে অফ ফান্ডি’ তেমনই এক জায়গা, যেখানে প্রতিদিন দু’বার পৃথিবীর সবচেয়ে উঁচু জোয়ার-ভাটা দেখা যায়। এখানকার বিশেষ আকর্ষণ হলো—সমুদ্রের পানি সরে গেলে কিছু সময়ের জন্য উন্মোচিত হয় এমন এক পথ, যেখানে পর্যটকরা সত্যিকারের সমুদ্রের তলদেশে হেঁটে যেতে পারেন।
প্রতিদিনের নির্দিষ্ট সময়ের জন্য জোয়ারের পানি কমে গেলে প্রকাশ পায় এক কিলোমিটার দীর্ঘ বালু ও পাথরের সরু পথ। সেই পথ ধরে পৌঁছানো যায় ‘মিনিস্টার্স আইল্যান্ড’-এ—নিউ ব্রান্সউইকের দক্ষিণ প্রান্তে অবস্থিত এক জোয়ার-ভাটা নির্ভর দ্বীপে। কিন্তু সময় পেরিয়ে গেলে, আবারো উত্তর আটলান্টিকের শীতল পানি ঢুকে পড়ে এবং সেই পথ ৬ মিটার গভীর সমুদ্রজলে হারিয়ে যায়।
সকালের দিকে ঘন বন আর নিস্তব্ধ শহর পেরিয়ে পৌঁছানো যায় দ্বীপটির কাছে। দূর থেকেই নোনতা সাগর বাতাসের গন্ধ টের পাওয়া যায়। তখনই চোখে পড়ে সমুদ্র থেকে সদ্য উন্মুক্ত হওয়া সেই তলদেশের পথ। কেউ কেউ হাঁটু পর্যন্ত পানিতে নেমে ঝিনুক বা ক্ল্যাম সংগ্রহ করছে, আবার কেউ সমুদ্রের তলায় পায়ের শব্দ তুলছে হালকা ছপছপ আওয়াজে।
দ্বীপটি শুধু যাত্রাপথ নয়, নিজেই এক অনন্য গন্তব্য। ২০০ হেক্টর আয়তনের এই দ্বীপ একসময় ছিল এক ধনী শিল্পপতির গ্রীষ্মকালীন আশ্রয়স্থল, যিনি কানাডার রেলপথ বিস্তারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিলেন। সেই সময়ের ঐতিহাসিক নিদর্শন আজও টিকে আছে—দ্বীপের অভিজাত কটেজ, স্নানাগার ও খামারবাড়িতে। এমনকি রেলওয়ে কোচের এক অংশ এখানে পানির ট্যাংক হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছিল।
দ্বীপে এখনো রয়েছে শান্ত, নিরিবিলি পরিবেশ। প্রায় ২০ কিলোমিটার লম্বা ট্রেইল ধরে হাঁটলে দেখা মেলে সমুদ্রের নীল তরঙ্গ, পাথরের ধূসর দেয়াল ও ঘন সবুজ গাছের সমন্বয়। জোয়ার উঠলে দ্বীপটি সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়, আবার ভাটা নামলে পৃথিবীর সঙ্গে যুক্ত হয়—প্রকৃতির এক অনবদ্য ছন্দ।
বে অফ ফান্ডি পৃথিবীর সর্বোচ্চ জোয়ার-ভাটার জন্য পরিচিত। প্রতিদিন প্রায় ১৬০ বিলিয়ন টন পানি এখানে ওঠানামা করে—যা বিশ্বের সব মিঠা নদীর পানির যোগফলের চেয়েও বেশি। এ বিশাল জলরাশি দিনে দু’বার প্রবাহিত হয়ে নিউ ব্রান্সউইক ও নোভা স্কোশিয়া প্রদেশকে আলাদা করে দেয়, আবার একত্রও করে। এখানকার জোয়ারের উচ্চতা কখনো কখনো ১২ মিটার পর্যন্ত পৌঁছায়, যা গ্লোবাল গড়ের ১২ গুণ।
এই অঞ্চল ভ্রমণে যারা আসেন, তারা শুধু সমুদ্রের তলদেশে হাঁটা নয়, আরও অনেক অভিজ্ঞতা লাভ করতে পারেন। যেমন—রেইকজাভিক ও স্ট অ্যান্ড্রুজ শহরের উপকূলে থেকে তিমি দেখা, যেখানে মিংক, ফিন ও উত্তর আটলান্টিক রাইট হোয়েল সহ প্রায় ডজনখানেক প্রজাতির তিমি এই উপসাগরে আসে খাবারের সন্ধানে।
দ্বীপের কাছাকাছি রয়েছে ‘হোপওয়েল রকস প্রভিনশিয়াল পার্ক’, যেখানে ২০টিরও বেশি পাথুরে স্তম্ভ বা সি স্ট্যাক সমুদ্রতলে দাঁড়িয়ে আছে। জোয়ারের সময় এগুলো ছোট ছোট দ্বীপে পরিণত হয়, আর ভাটার সময় মানুষ হেঁটে যেতে পারে তাদের গোড়ালির কাছে। স্থানীয় মিকম্যাক ও পাসামাকোয়াডি জাতিগোষ্ঠীর লোককথা অনুযায়ী, এসব পাথর একসময় ছিল মানুষ, যাদের সমুদ্রের দেবতা পাথরে পরিণত করেছিলেন।
এ অঞ্চলে আরও রয়েছে জগিন্স ফসিল ক্লিফস—একটি ইউনেস্কো ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইট, যেখানে পাওয়া গেছে ৩০ কোটিরও বেশি বছর পুরনো জীবাশ্ম। এটি পৃথিবীর প্রাচীনতম বনভূমির এক ঝলক দেখায়, যেখানে বিশাল গাছ, প্রাচীন সরীসৃপ ও পতঙ্গ একসাথে বাস করত। ভাটার সময় এখানে গাইডের সহায়তায় পর্যটকরা এই প্রাচীন জীবাশ্মগুলো দেখতে পান।
বে অফ ফান্ডি শুধু প্রকৃতির সৌন্দর্য নয়, সময়ের সাক্ষীও বটে। এর জোয়ার-ভাটা প্রতিদিন আমাদের মনে করিয়ে দেয়—প্রকৃতির শক্তি, ইতিহাস ও রহস্য কতটা গভীর হতে পারে।



