উচ্চশিক্ষা খাতে ধীরে ধীরে বাড়ছে অস্থিরতা ও হতাশা। সরকারের সদ্য ঘোষিত তহবিল পরিকল্পনা বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে সৃষ্ট মনোবল–সংকট লাঘবের পরিবর্তে আরও অনিশ্চয়তার জন্ম দিয়েছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, বিশ্ববিদ্যালয়ের টিউশন ফি ২০২৬ সাল থেকে মুদ্রাস্ফীতির সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে বাড়ানোর সিদ্ধান্ত শিক্ষার্থীদের জন্য বড় ধাক্কা হলেও, দীর্ঘ আট বছরের ফি স্থবিরতা যে বড় ধরনের অর্থনৈতিক সঙ্কট সৃষ্টি করেছিল, সেটিই সরকারকে এই সিদ্ধান্তে বাধ্য করেছে।
তবে, একই সঙ্গে আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থীদের জন্য নতুন ফি লেভি বা অতিরিক্ত কর আরোপের পরিকল্পনা ঘোষণায় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে দেখা দিয়েছে উদ্বেগ। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের মতে, এই সিদ্ধান্ত দেশে ও বিদেশে উচ্চশিক্ষার মান ও আকর্ষণ—দুটোকেই ক্ষতিগ্রস্ত করবে। নতুন সারচার্জ থেকে আসা রাজস্বের চেয়ে ক্ষতি হবে অনেক বেশি।
ইতিমধ্যেই ইংল্যান্ডের প্রায় ৪০ শতাংশ বিশ্ববিদ্যালয় আর্থিক ঘাটতিতে রয়েছে। দীর্ঘদিন ধরে চলা ‘মার্কেটভিত্তিক’ উচ্চশিক্ষা মডেল এখন নিজেই তার দুর্বলতা প্রকাশ করছে। সরকারি সহায়তার অভাবে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো বাণিজ্যিক প্রতিযোগিতার ভেতরে বন্দী হয়ে পড়েছে। এর ফলেই ক্যাম্পাসগুলোতে বাড়ছে অস্থিতিশীলতা, হ্রাস পাচ্ছে শিক্ষক ও কর্মীদের মনোবল, যা শিক্ষার গুণগত মানকেও প্রভাবিত করছে।
বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজ ইউনিয়নের সাম্প্রতিক তথ্য অনুযায়ী, গত এক বছরে ১২,০০০–এরও বেশি কর্মসংস্থান হারিয়েছে উচ্চশিক্ষা খাত। কিছু বিশ্ববিদ্যালয়ে ইতিমধ্যেই শিক্ষকরা কর্মবিরতি পালন করেছেন, অন্য অনেক প্রতিষ্ঠানে ধর্মঘটের প্রস্তুতিও চলছে। এ অবস্থায় শিক্ষাক্ষেত্রে এক ভয়াবহ অনিশ্চয়তা তৈরি হয়েছে।
সরকার বলছে, ভবিষ্যতে টিউশন ফি বৃদ্ধির শর্ত হবে প্রতিষ্ঠানগুলোর মানোন্নয়ন ও শিক্ষার্থীদের জন্য “বিশ্বমানের শিক্ষা” নিশ্চিত করা। কিন্তু বাস্তবতা ভিন্ন—বছরের পর বছর বাজেট সংকোচনের কারণে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো খরচ কমাতে বাধ্য হচ্ছে। শিক্ষকদের চাকরির নিরাপত্তা কমছে, ছাত্র-শিক্ষক অনুপাত বাড়ছে, প্রশাসনিক কাজের চাপ বেড়েছে, এবং মজুরি গত ১৫ বছরে বাস্তব অর্থে প্রায় ২০ শতাংশ হ্রাস পেয়েছে। এর ফলে শিক্ষকদের মানসিক চাপ বেড়েছে এবং শিক্ষার পরিবেশ ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।
এই পরিস্থিতিতে শিক্ষার্থীরা যেমন ক্ষতিগ্রস্ত, তেমনি শিক্ষকরাও এক দমবন্ধ অবস্থার মধ্যে রয়েছেন। অনেক বিশ্ববিদ্যালয় এখন টিকে থাকার লড়াইয়ে ব্যস্ত। সম্ভাব্য আর্থিক সংকট সামলাতে একীভূতকরণের (মার্জার) প্রবণতাও বাড়ছে, যা অনিশ্চয়তাকে আরও গভীর করছে।
সরকার আপাতত বাজারনীতির ওপর ভরসা রেখে পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করছে। কিন্তু বর্তমান ফি-নির্ভর শিক্ষা ব্যবস্থা, যেখানে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো ছাত্রদের কাছ থেকে প্রাপ্ত অর্থে পরিচালিত ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে, সেটি একটি অস্বাস্থ্যকর প্রতিযোগিতার জন্ম দিচ্ছে। ফলস্বরূপ, গবেষণা, শিক্ষকতা ও শিক্ষার গুণমান তিনটিই মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।
বিশেষজ্ঞদের মত, এখনই যদি টেকসই ও স্থিতিশীল সরকারি তহবিল ব্যবস্থা গড়ে না তোলা যায়, তাহলে উচ্চশিক্ষা ব্যবস্থায় দীর্ঘমেয়াদি ক্ষতির আশঙ্কা প্রবল। সময় এসেছে মাঠের বাস্তবতা বোঝার, বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের কণ্ঠ শোনার এবং শিক্ষার্থীদের ভবিষ্যৎ রক্ষায় কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়ার। কারণ, তাদেরই ওপর নির্ভর করছে দেশের আগামী প্রজন্মের জ্ঞানভিত্তিক উন্নয়ন।



