বাংলাদেশের শক্তিমান কথাসাহিত্যিক ইউসুফ শরীফ তাঁর ৫০ বছরের সাহিত্যকর্মে যে সমাজ চিত্র পাঠকদের কাছে তুলে ধরেছেন, এমনটা আগে কোনো লেখক করেননি। বিগত পঞ্চাশ বছরের অধিককাল ধরে তাঁর গল্প ও উপন্যাস পাঠকের হৃদয় আন্দোলিত করে আসছে। তিনি দৈনিক আজাদ, দৈনিক ইত্তেফাক এবং দৈনিক ইনকিলাব-এ সুদীর্ঘকাল খ্যাতিমান সাংবাদিক হিসেবেও অবদান রেখেছেন।
কথাসাহিত্যিক ইউসুফ শরীফ তাঁর গল্পে সমাজ, সময় আর ইতিহাসধৃত ব্যক্তি মানুষের স্বরূপ অন্বেষার প্রয়াস পেয়েছেন। সে কারণেই তাঁর গল্পগুচ্ছে রাষ্ট্রসংকটের উপস্থিতি এমন পৌনঃপুনিক। ব্যক্তিগত সুখ-দুঃখ, আশা-নিরাশা নিয়েও তাঁর একাধিক গল্পে রাষ্ট্রসংকটের বিষয়টি উঠে এসেছে। লেখনিতে তিনি মানুষের অন্তর্জীবন চেতনা ও বহির্জীবন চেতনার শিল্পিত সমন্বয় ঘটিয়েছেন। আবার কোনো কোনো গল্পে তিনি ঘটনাকে প্রতিক্রিয়ায় রূপ দিয়েছেন এবং সেই প্রতিক্রিয়াজাত আবেগ-উত্তাপকে চিত্রে অঙ্কন করেছেন।
ইউসুফ শরীফের কয়েকটি গল্পে দেখা যায় প্রকৃতিও মধ্যবর্তী চরিত্রের পর্যায়ে উন্নীত হয়েছে। এসব গল্পের আত্মস্থ রচনাশৈলী তাঁর গল্পকে প্রায় কবিতার স্তরে উন্নীত করেছে, যেখানে মানুষ এবং প্রকৃতি প্রায় একাত্ম মননধর্মী ও মনোধর্মী দু’ধারার গল্পই তিনি লিখেছেন। সমাজতান্ত্রিক বাস্তববাদের দৃষ্টিতে মানুষ কালের পরিমাপে ত্রিমাত্রায় যুক্ত—অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যতে প্রসারিত সামাজিক ব্যক্তি।
তাঁর সাহিত্য শক্তির উৎস মানবীয় দৃষ্টিভঙ্গি, নিজস্ব গদ্যভাষা ও আধুনিক প্রকাশরীতি। তাঁর কথাসাহিত্যের বড় অংশই মুক্তিযুদ্ধ কেন্দ্রিক। তিনি মানুষের অপ্রকাশিত মনোজগতের ঘেরাটোপ থেকে আসল মানুষকে—বিশেষ করে প্রান্তিক মানুষ ও তাদের অসহায়ত্বকে তুলে ধরেছেন। তাঁর সাহিত্য কর্ম মানব চেতনা, সমাজের গভীর পর্যবেক্ষণ, সৃজনমুখর গদ্য এবং শিল্পপ্রয়োগশৈলীর নৈপুণ্যে সমৃদ্ধ।
প্রকাশিত গ্রন্থ
গল্পগ্রন্থ : ‘নির্বাচিত গল্প’, ‘মুহূর্তের বৃত্তান্ত’, ‘যুদ্ধের পর’, ‘যুদ্ধদিন’ মুক্তিযুদ্ধের নির্বাচিত গল্প, ‘চেনা অচেনার মাঝখানের মানুষ’, ‘প্রস্তিকজনের গল্প’, ‘তিন দেশের সেরা গল্প’, ‘ইউরোপের রূপকথা’।
উপন্যাস : ‘উপন্যাসসমগ্র- এক’, ‘উপন্যাসসমগ্র- দুই’, ‘ধ্বনির বিস্ফোরণ’ [মুক্তিযুদ্ধের নির্বাচিত উপন্যাস], ‘গ্রহণ’, ‘শুধু বাঁশি শুনেছি’, ‘স্বপ্নের চারুলতা’, ‘তোমাকেই শুধু’, ‘পরম মাটি’, ‘সেই মেয়েটি’, ‘রুদ্ধ নগরীর বালকেরা’, ‘শিকড়’, ‘মানুষমাছি’, ‘নীল জোছনায় বৃষ্টি’।
কলাম : ‘অস্তিত্বের লড়াই’।
প্রকাশিতব্য গ্রন্থ
‘গল্পসমগ্র- এক’, ‘উপন্যাসসমগ্র- তিন’, ‘গল্পসমগ্র- দুই : মুক্তিযুদ্ধ’, ‘পূর্বপুরুষগণ’, ‘দেখেছি জেনেছি যাদের’, ভ্রমণ গদ্য—‘রাইনের তীরে’।
কথাসাহিত্যিক ইউসুফ শরীফের জন্ম ১৯৪৮ সালের ২১ জানুয়ারি, ময়মনসিংহ নগরীর ব্রহ্মপুত্র পাড়ে। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলাভাষা ও সাহিত্যে মাস্টার্স সম্পন্ন করেন (১৯৭২)। প্রায় সাড়ে চার দশক জাতীয় দৈনিক আজাদ, ইত্তেফাক ও ইনকিলাব-এ শীর্ষস্থানীয় পদে দায়িত্ব পালন করেছেন এবং ‘রাহাগীর’ নামে জনপ্রিয় কলাম লিখেছেন।
তিনি জার্মানিতে সাংবাদিকতা বিষয়ক উচ্চতর প্রোগ্রামে অংশগ্রহণ করেছেন। ‘কথাসাহিত্য কেন্দ্র’র প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি। ডিইউজে’র দু’বার সহ-সভাপতি, একবার ইসি সদস্য এবং জাতীয় প্রেসক্লাবের স্থায়ী সদস্য। এখনো তিনি অবিরাম লিখে চলেছেন।