প্রায় ছয় দশক ধরে পেশাদার সংগীতজীবনে অমলিন দৃষ্টান্ত রেখে আসা সাবিনা ইয়াসমীনকে রবিবার সন্ধ্যায় রাষ্ট্রীয় সম্মাননা প্রদান ও একক সংগীতানুষ্ঠানের মাধ্যমে স্মরণ করা হয়। দীর্ঘদিন অসুস্থতার কারণে তিনি তেমন প্রকাশ্যে গান করতে পারেননি, তবে গতকাল সন্ধ্যা ছিল তাঁর জন্য এবং ভক্তদের জন্য এক অবিস্মরণীয় মুহূর্ত। অনুষ্ঠানটি অনুষ্ঠিত হয় শিল্পকলা একাডেমিতে, সংস্কৃতিবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের আয়োজন এবং শিল্পকলা একাডেমির ব্যবস্থাপনায়।
অনুষ্ঠানের প্রস্তুতি শুরু হয় গত সপ্তাহেই। শিল্পকলা একাডেমির মহড়াকক্ষে শিল্পী ১৬ সদস্যের যন্ত্রদল নিয়ে নানা রিহার্সালে ব্যস্ত ছিলেন। মহড়াকক্ষে তবলা, হারমোনিয়াম, কি-বোর্ড, গিটার ও বেহালার সুরে মিশে গিয়েছিল শিল্পীর কণ্ঠ। গানের প্রতিটি তালে প্রাণফুর্তি, একাগ্রতা ও নিষ্ঠা স্পষ্ট ছিল। অনুষ্ঠানের আগে এমন মহড়া এখনো নিয়মিত করেন তিনি, যা তাঁর পেশাদারিত্ব ও শিল্পচেতনাকে প্রতিফলিত করে।
সন্ধ্যা ৭টা ২৭ মিনিটে অনুষ্ঠান শুরু হয়। শুরুতে প্রয়াত একজন বিশিষ্ট লেখক ও গবেষক ও জাতীয় মুক্তিকাউন্সিলের সভাপতির স্মৃতিতে এক মিনিট নীরবতা পালন করা হয়। এরপর প্রদর্শিত হয় সাবিনা ইয়াসমীনকে কেন্দ্র করে সংস্কৃতিবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের তৈরি সংক্ষিপ্ত প্রামাণ্যচিত্র, যেখানে তাঁর সমসাময়িক ও পরবর্তী প্রজন্মের শিল্পীরা তাঁর প্রতিভা ও সংগীত জীবন নিয়ে কথা বলেন।
প্রামাণ্যচিত্র প্রদর্শনের পর শিল্পকলা একাডেমির শিল্পীরা সাবিনা ইয়াসমীনের গানের তালে নৃত্য পরিবেশন করেন। এরপর মঞ্চে উঠে সংস্কৃতিবিষয়ক উপদেষ্টা বলেন, দেশের শিল্প ও সাংস্কৃতিক ঐশ্বর্যকে উদযাপন করতে এই অনুষ্ঠান আয়োজন করা হয়েছে। তিনি উল্লেখ করেন, ‘আজকের এই সন্ধ্যায় আমরা কিংবদন্তি শিল্পী সাবিনা ইয়াসমীনের গান উপভোগ করব এবং রাষ্ট্রীয় সম্মাননা প্রদান করা হবে।’
প্রথমে সংস্কৃতিমন্ত্রণালয় থেকে সম্মাননা প্রদানের কথা থাকলেও পরে সিদ্ধান্ত হয় রাষ্ট্রের পক্ষ থেকেই সম্মাননা দেওয়া হবে। সাবিনা ইয়াসমীন এই প্রস্তাব পেয়ে আনন্দ প্রকাশ করেন। অনুষ্ঠানেই পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের একজন উপদেষ্টা তাঁকে উত্তরীয় ও ক্রেস্ট দিয়ে রাষ্ট্রীয় সম্মাননা প্রদান করেন এবং জন্মদিনের শুভেচ্ছা জানানো হয়। উপস্থিত ছিলেন মন্ত্রিপরিষদ ও সংস্কৃতিবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তারা। শিল্পী তাঁর আন্তরিক ধন্যবাদ জানিয়ে অনুষ্ঠান পরিচালনা ও সম্মাননায় অংশগ্রহণকারীদের কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন।
স্মৃতিচারণা ও গানানুষ্ঠানের দ্বিতীয় পর্বে সাবিনা ইয়াসমীন একে একে দশটি গান পরিবেশন করেন, যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য গান হলো ‘সুন্দর সুবর্ণ’, ‘আমি রজনীগন্ধা’, ‘ফুল যদি ঝরে গিয়ে’, ‘শত জনমের স্বপ্ন’, ‘অশ্রু দিয়ে লেখা’, ‘এই মন তোমাকে দিলাম’, ‘আমি আছি থাকব’, ‘ইশারায় শিস দিয়ে’, ‘শুধু গান গেয়ে পরিচয়’ এবং ‘সে যে কেন এল না’। ফাঁকে ফাঁকে শিল্পীরা তাঁর সঙ্গে স্মৃতিচারণা করেন, যা অনুষ্ঠানের সৌন্দর্য আরও বাড়িয়ে তোলে। এ সময় ‘মহানায়ক বুলবুল আহমেদ স্মৃতি সম্মাননা ২০২৫’ পদকও প্রদান করা হয়।
রাত ৯টা ৪৫ মিনিটে শেষ গান পরিবেশনের মাধ্যমে অনুষ্ঠান সমাপ্ত হয়। শিল্পীর সঙ্গে মঞ্চে ছিলেন খুরশীদ আলম, রফিকুল আলম, আবিদা সুলতানা, নকীব খান, ফেরদৌস আরা, পার্থ বড়ুয়া ও আগুন। রাত ১০টার দিকে দর্শকরা মনে রাখার মতো এক সন্ধ্যার স্মৃতি নিয়ে ফিরেন।
সাবিনা ইয়াসমীন ১৯৫৪ সালের ৪ সেপ্টেম্বর সাংস্কৃতিক পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। ছয় বছর বয়সে গান গেয়ে প্রথম পুরস্কার অর্জন করেন এবং ১৯৬২ সালে অনুষ্ঠানিকভাবে সংগীতে প্রবেশ করেন। একই বছর চলচ্চিত্রে শিশুশিল্পী হিসেবে প্লেব্যাক শুরু করেন। পরবর্তীতে বিভিন্ন কিংবদন্তি সুরকারের সঙ্গে কাজ করে তিনি বাংলা গানের অপরিহার্য কণ্ঠস্বর হয়ে ওঠেন। আধুনিক গান, পল্লিগীতি, রবীন্দ্রসংগীত, নজরুলসংগীত ও গজল—সব ক্ষেত্রে তিনি স্বতন্ত্র স্বাক্ষর রেখেছেন। ১৫ বার জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার জিতেছেন, অর্জন করেছেন একুশে পদক ও স্বাধীনতা পুরস্কারসহ অসংখ্য সম্মাননা। ২০২০ সালে শেষবার চলচ্চিত্রে গান ও প্রথমবার সুরকার হিসেবেও কাজ করেন।