বিশ্বের প্রধান পারমাণবিক শক্তিধর দেশগুলোর মধ্যে নতুন উত্তেজনা সৃষ্টি করেছে যুক্তরাষ্ট্রের সর্বশেষ ঘোষণা। যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ঘোষণা দিয়েছেন, দেশটি রাশিয়া ও চীনের সঙ্গে “সমান ভিত্তিতে” পারমাণবিক অস্ত্র পরীক্ষা শুরু করবে। এই সিদ্ধান্ত মার্কিন পারমাণবিক নীতিতে এক বড় পরিবর্তন আনতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
দক্ষিণ কোরিয়ার বুসানে চীনের শীর্ষ নেতার সঙ্গে বৈঠকের ঠিক আগে প্রেসিডেন্ট এই ঘোষণা দেন। বৈঠকটির উদ্দেশ্য ছিল প্রায় এক বছরের বাণিজ্য ও অর্থনৈতিক অস্থিরতার পর দুই দেশের মধ্যে স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনা।
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে দেওয়া এক পোস্টে প্রেসিডেন্ট বলেন, “যুক্তরাষ্ট্রের পারমাণবিক অস্ত্র ভাণ্ডার বিশ্বের যেকোনো দেশের চেয়ে বড়।” তিনি উল্লেখ করেন, রাশিয়া রয়েছে দ্বিতীয় অবস্থানে এবং চীন “অনেক পিছিয়ে” থাকলেও দ্রুত এগিয়ে আসছে।
তিনি আরও জানান, “অন্য দেশগুলোর পরীক্ষামূলক কার্যক্রমের কারণে আমি প্রতিরক্ষা বিভাগকে নির্দেশ দিয়েছি যুক্তরাষ্ট্রের পারমাণবিক অস্ত্রের পরীক্ষা শুরু করতে। এই প্রক্রিয়া অবিলম্বে শুরু হবে।”
তবে তিনি যে পরীক্ষার কথা বলেছেন, সেটি সরাসরি পারমাণবিক বিস্ফোরণমূলক পরীক্ষা নাকি পারমাণবিক সক্ষম অস্ত্রব্যবস্থার পরীক্ষা—তা এখনও পরিষ্কার নয়। উল্লেখযোগ্য যে, ১৯৯০-এর দশক থেকে বিশ্বের তিন প্রধান সামরিক শক্তির কেউই পারমাণবিক অস্ত্রের বিস্ফোরণমূলক পরীক্ষা পরিচালনা করেনি। চীনের সর্বশেষ এমন পরীক্ষা হয়েছিল ১৯৯৬ সালে।
যুক্তরাষ্ট্র সর্বশেষ পারমাণবিক পরীক্ষা চালায় ১৯৯২ সালে, যার পর থেকে দেশটি স্বেচ্ছায় এমন বিস্ফোরণমূলক পরীক্ষার ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে। যুক্তরাষ্ট্রের কংগ্রেসনাল রিসার্চ সার্ভিসের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, প্রেসিডেন্টের নির্দেশের পর নতুন করে এমন একটি পরীক্ষা বাস্তবায়ন করতে ২৪ থেকে ৩৬ মাস সময় লাগতে পারে।
বিশ্লেষকরা বলছেন, এই ঘোষণা এমন এক সময় এলো, যখন যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের মধ্যে প্রতিদ্বন্দ্বিতা ঠান্ডা যুদ্ধ-পরবর্তী উত্তেজনার নতুন রূপ নিচ্ছে। পাশাপাশি রাশিয়ার ইউক্রেন যুদ্ধ পশ্চিমা বিশ্বের সঙ্গে সংঘাতকে আরও জটিল করে তুলেছে।
বিশ্বজুড়ে নজর রাখা হচ্ছে রাশিয়া ও চীনের পারমাণবিক সক্ষমতা বৃদ্ধির দিকেও। সম্প্রতি রাশিয়া নতুন একটি পারমাণবিক সক্ষম ক্রুজ মিসাইল ও পারমাণবিকচালিত টর্পেডো পরীক্ষার দাবি করেছে। রাশিয়া ও যুক্তরাষ্ট্র মিলেই বিশ্বের প্রায় ৯০ শতাংশ পারমাণবিক অস্ত্রের মালিক।
ক্রেমলিনের মুখপাত্র জানিয়েছেন, যদি কোনো দেশ পারমাণবিক পরীক্ষার স্থগিতাদেশ ভঙ্গ করে, তবে রাশিয়া “প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা” নেবে। তিনি আরও বলেন, বর্তমানে একটি বৈশ্বিক পরীক্ষামূলক স্থগিতাবস্থা চলছে এবং রাশিয়া এর বাইরে কোনো পরীক্ষা চালায়নি।
অন্যদিকে, চীনের পারমাণবিক ভাণ্ডার দ্রুত বৃদ্ধি পাচ্ছে। ধারণা করা হচ্ছে, এই দশকের শেষে দেশটির হাতে ১,০০০-এর বেশি পারমাণবিক অস্ত্র থাকতে পারে। চীন ইতিমধ্যেই একাধিক আন্তঃমহাদেশীয় ক্ষেপণাস্ত্র উৎক্ষেপণ কেন্দ্র তৈরি করেছে এবং ২০২৪ সালে প্রশান্ত মহাসাগরে একটি আইসিবিএম পরীক্ষা করেছে।
বিশ্লেষকরা মনে করছেন, যুক্তরাষ্ট্রের নতুন এই পদক্ষেপ বৈশ্বিক অস্ত্র প্রতিযোগিতাকে আরও তীব্র করে তুলতে পারে। এতে রাশিয়া, চীন, ভারত ও পাকিস্তানের মতো দেশগুলোও নিজেদের পরীক্ষামূলক কর্মসূচি পুনরায় শুরু করতে উৎসাহিত হতে পারে।
একজন পারমাণবিক বিশেষজ্ঞ বলেন, “যদি যুক্তরাষ্ট্র সত্যিই বিস্ফোরণমূলক পরীক্ষা শুরু করে, তা হবে অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ পদক্ষেপ। এতে শুধু আন্তর্জাতিক ভারসাম্যই নষ্ট হবে না, বরং নতুন অস্ত্র প্রতিযোগিতার সূচনা ঘটবে।”
এদিকে, চীনের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, তারা আশা করে যুক্তরাষ্ট্র পারমাণবিক পরীক্ষা স্থগিত রাখার প্রতিশ্রুতি বজায় রাখবে এবং বৈশ্বিক নিরস্ত্রীকরণ ও স্থিতিশীলতা রক্ষায় ভূমিকা রাখবে।
অঞ্চলভিত্তিকভাবে এই ঘোষণা বিশেষ করে এশিয়ার নিরাপত্তা পরিস্থিতিতে বড় প্রভাব ফেলতে পারে, যেখানে ইতিমধ্যেই ভারত, পাকিস্তান ও উত্তর কোরিয়া পারমাণবিক অস্ত্র ধারণ করে। উল্লেখযোগ্যভাবে, উত্তর কোরিয়া ২০১৭ সালে বিশ্বের সর্বশেষ পারমাণবিক পরীক্ষা চালায়।
বিশ্লেষকদের মতে, যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া ও চীনের সাম্প্রতিক কার্যক্রম ইঙ্গিত দিচ্ছে, বিশ্ব আবারও পারমাণবিক পরীক্ষার নতুন যুগে প্রবেশ করতে পারে।



