নোবেল পুরস্কারকে বিজ্ঞানের সর্বোচ্চ স্বীকৃতি হিসেবে বিবেচনা করা হয়। সুইডিশ উদ্ভাবক আলফ্রেড নোবেলের ইচ্ছানামার ভিত্তিতে এই পুরস্কারের যাত্রা শুরু হলেও, ইতিহাস ঘাঁটলে দেখা যায়—অনেক প্রথিতযশা বিজ্ঞানীর যুগান্তকারী অবদান থেকেও নোবেল পুরস্কার মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে। তাদের গবেষণা মানব সভ্যতার ধারা বদলে দিয়েছে, কিন্তু স্বীকৃতির পাল্লায় তারা রয়ে গেছেন অবহেলিত।
বিংশ শতাব্দীর অন্যতম তাত্ত্বিক পদার্থবিজ্ঞানী একজন ব্রিটিশ বিজ্ঞানী, যিনি ব্ল্যাকহোল নিয়ে অসাধারণ তত্ত্ব উপস্থাপন করেছিলেন, তার নাম আজও বিজ্ঞান জগতে আলোচিত। সাধারণ আপেক্ষিকতা ও কোয়ান্টাম মেকানিকসের মধ্যে সংযোগ ঘটিয়ে তিনি মহাকাশের রহস্য উন্মোচনের নতুন দুয়ার খুলেছিলেন। তাঁর প্রস্তাবিত ‘রেডিয়েশন’ তত্ত্বে বলা হয়, ব্ল্যাকহোল থেকেও কণা নির্গত হতে পারে। কিন্তু এই তত্ত্বটি পরীক্ষামূলকভাবে প্রমাণিত না হওয়ায় তিনি জীবদ্দশায় নোবেল পাননি।
ঠিক একইভাবে, পারমাণবিক বিভাজন আবিষ্কারে এক নারী বিজ্ঞানীর অবদানও অবহেলিত হয়েছিল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় নাৎসি নির্যাতনের কারণে তিনি দেশ ছাড়তে বাধ্য হন। তাঁর গবেষণা ও তাত্ত্বিক বিশ্লেষণ ছিল পারমাণবিক শক্তির মূল ভিত্তি, কিন্তু তাঁর সহগবেষক একাই সেই কাজের কৃতিত্ব পান এবং রসায়নে নোবেল জয় করেন। এই ঘটনা আজও নারী বিজ্ঞানীদের প্রতি বৈষম্যের এক দৃষ্টান্ত হিসেবে উল্লেখ করা হয়।
ভারতীয় বিজ্ঞান অঙ্গনের এক কিংবদন্তি তাত্ত্বিক একজন পদার্থবিজ্ঞানী কোয়ান্টাম মেকানিকসের ওপর এমন এক অবদান রাখেন, যা পরে আধুনিক কণাপদার্থবিজ্ঞানের ভিত্তি হয়ে দাঁড়ায়। তাঁর কাজ থেকেই ‘বোস-আইনস্টাইন পরিসংখ্যান’ ও ‘বোস-আইনস্টাইন কনডেনসেট’-এর ধারণা আসে। আজ মহাবিশ্বের অর্ধেক মৌলিক কণার নামেই তাঁর নাম যুক্ত — ‘বোসন কণা’। তবুও তাঁর প্রাপ্য স্বীকৃতি আসেনি নোবেল পুরস্কারের মঞ্চ থেকে।
আরেক ব্রিটিশ নারী বিজ্ঞানী ১৯৫০-এর দশকে এক্স-রে প্রযুক্তি ব্যবহার করে ডিএনএর গঠন প্রকাশে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখেন। তাঁর তোলা বিখ্যাত ‘ফোটো–৫১’ ছবিই ডিএনএর ডাবল হেলিক্স কাঠামো আবিষ্কারে অন্য গবেষকদের সঠিক পথে পরিচালিত করে। কিন্তু অকালমৃত্যুর কারণে তিনি মরণোত্তর নোবেল পাননি। কারণ নোবেল পুরস্কার জীবিতদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ।
রাশিয়ার এক রসায়নবিদ ১৮৬৯ সালে মৌলগুলোর পর্যায় সারণি তৈরি করে বিজ্ঞানের ইতিহাসে বিপ্লব ঘটিয়েছিলেন। মৌলগুলোকে পারমাণবিক ওজন অনুযায়ী সাজিয়ে তিনি ভবিষ্যতের অনাবিষ্কৃত মৌলগুলোর বৈশিষ্ট্যও নির্ভুলভাবে ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন। যদিও তাঁর কাজের সময় নোবেল পুরস্কার চালু হয়নি, জীবদ্দশায় মনোনয়নের তালিকায় থাকলেও তিনি পুরস্কৃত হননি।
তেমনি, এক ব্রিটিশ নারী জ্যোতির্বিজ্ঞানী ১৯৬০-এর দশকে ছাত্রাবস্থায় ‘পালসার’ নামের এক মহাজাগতিক ঘটনা আবিষ্কার করেন—যা আধুনিক জ্যোতির্পদার্থবিজ্ঞানে নতুন দিগন্ত উন্মোচন করে। কিন্তু তাঁর আবিষ্কারের জন্য নোবেল গিয়েছিল তাঁর তত্ত্বাবধায়ক অধ্যাপকের হাতে, বাদ পড়েছিলেন প্রকৃত আবিষ্কারক নিজে।
এই তালিকায় আরও দেখা যায়—বিদ্যুৎ ও তড়িৎচুম্বকত্বের পথিকৃৎ এক উদ্ভাবকও নোবেল পাননি। তাঁর গবেষণা আধুনিক প্রযুক্তির ভিত্তি গড়ে দিয়েছে, তবুও পুরস্কার তাঁর ভাগ্যে জোটেনি। এমনকি, আপেক্ষিকতার তত্ত্বের স্রষ্টাও নোবেল পান কেবল ফটোইলেকট্রিক ইফেক্টের জন্য, তাঁর বিখ্যাত ‘E = mc²’ সমীকরণের জন্য নয়।
ইতিহাসের এসব উদাহরণ মনে করিয়ে দেয়—নোবেল পুরস্কার বিজ্ঞানীদের অবদানকে সম্মানিত করলেও, সবসময় সত্যিকারের প্রতিভাকে মূল্যায়ন করতে পারে না। অনেক মহান বিজ্ঞানী রয়েছেন, যাদের কাজ মানব সভ্যতার অগ্রযাত্রাকে বদলে দিয়েছে—তাদের অবদানই প্রকৃত নোবেল স্বীকৃতি।



