দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সবচেয়ে রক্তক্ষয়ী ল্যান্ড ব্যাটলগুলোর একটির শেষ প্রান্তে ঘটে গিয়েছিল এক বিস্ময়কর ঘটনা। যখন মার্কিন ও জাপানি সৈন্যরা অস্ত্র নামিয়ে একসাথে বসেছিল—যুদ্ধ নয়, বরং একসাথে খাওয়া, কথা বলা ও প্রার্থনার জন্য। এই ঘটনাটি ঘটে ১৯৪৫ সালে, জাপানের একটি দ্বীপ—আকা-তে।
রাজনৈতিক ভূগোল গবেষক এক অধ্যাপক, যিনি ঘটনাটি নিয়ে গবেষণা করেছেন, বলেন, “এটি প্রথম বিশ্বযুদ্ধের বড়দিনের সাময়িক যুদ্ধবিরতির মতোই, বরং আরও বিস্ময়কর। কারণ তখন মার্কিন ও জাপানি বাহিনীর মধ্যে ছিল ভয়াবহ ঘৃণা ও আতঙ্ক।”
দীর্ঘ সময় ধরে ঘটনাটি খুব বেশি পরিচিত ছিল না। এমনকি দ্বীপের বহু বাসিন্দাও জানতেন না তাদের মাটিতে এমন মানবিক মুহূর্ত ঘটেছিল।
গবেষণা অনুযায়ী, ১৯৪৫ সালে ওকিনাওয়া যুদ্ধের প্রেক্ষাপটে আকা দ্বীপে মার্কিন সেনারা ও জাপানি সেনারা মুখোমুখি অবস্থানে ছিল। তখন হঠাৎ করেই যুদ্ধ থেমে যায়, এবং উভয় পক্ষ অস্ত্র নামিয়ে কথা বলতে শুরু করে। তারা একসাথে খাবার ভাগাভাগি করে খায়, এমনকি একসাথে প্রার্থনাও করে।
এই ঘটনার সূত্রপাত হয় মার্কিন সেনা কর্মকর্তা লেফটেন্যান্ট কর্নেল জর্জ ক্লার্কের উদ্যোগে। তিনি জাপানি গ্যারিসনের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন করে প্রাণহানি রোধ করতে চেয়েছিলেন। কয়েকজন জাপানি যুদ্ধবন্দির সহায়তায় মার্কিন বাহিনী দ্বীপ ঘুরে surrender-এর আহ্বান জানায়।
এক পর্যায়ে মার্কিন সেনা ডেভিড ওসবর্ন সৈকতে গিয়ে পতাকা রেখে আসে, যাতে লেখা ছিল আলোচনার আহ্বান। পরে জাপানি কমান্ডার মেজর নোদা আলোচনায় রাজি হন, তবে শর্ত দেন—এটি যেন জাপানি কর্মকর্তা মেজর ইউতাকা উমেজাওয়ার উপস্থিতিতে হয়, যিনি তখন আহত অবস্থায় মার্কিন বাহিনীর হাতে বন্দি ছিলেন।
২৬ জুন, উভয় পক্ষ সৈকতে মিলিত হয়। পাহাড়ে অবস্থান নেয়া জাপানি সেনারা তাকিয়ে ছিল; একটিমাত্র ভুল সিদ্ধান্ত মানে মৃত্যুঝুঁকি। কিন্তু পরিস্থিতি বদলে যায়—দুই কমান্ডার অস্ত্র নামিয়ে একে অপরকে স্যালুট করে। শুরু হয় আলোচনা। এরপর সৈকতে রান্না হয় ভাজা শূকর মাংস, এবং সবাই একসাথে বসে খায়।
ক্লার্ক তাঁর রিপোর্টে লিখেছিলেন, “আমার জীবনে দেখা সবচেয়ে আশ্চর্য দৃশ্য এটি।”
যদিও জাপানি বাহিনী আত্মসমর্পণ করতে পারেনি, উভয় পক্ষ যুদ্ধবিরতিতে সম্মত হয়। মার্কিন কর্মকর্তা ক্লার্ক বিদায়ের আগে প্রস্তাব দেন, সবাই যেন শান্তি ও মানবিকতার জন্য একসাথে প্রার্থনা করে। সেই প্রার্থনায় অংশ নেন উভয় বাহিনী।
এই যুদ্ধবিরতি টিকে ছিল আগস্টে জাপানের চূড়ান্ত আত্মসমর্পণ পর্যন্ত। এর পর থেকে আকা দ্বীপে আর কোনো প্রাণহানি হয়নি।
বছর কয়েক পর ঘটনাটি প্রকাশ্যে আসে যখন এক জাপানি বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক বিমানযাত্রায় এক প্রবীণ দম্পতির সঙ্গে কথা বলেন, যারা যুদ্ধের সময় আকা দ্বীপে শিশু ছিলেন। তাদের কাছ থেকেই জানা যায় যুদ্ধবিরতির গল্পটি। পরে সেই শিক্ষক পুরনো একটি ছবিও খুঁজে পান—যেখানে দেখা যায় জাপানি ও মার্কিন সৈন্যরা একসাথে সৈকতে বসে প্রার্থনা করছে।
এই ছবি দেখে গবেষক অধ্যাপক আবেগে আপ্লুত হয়ে পড়েন। তিনি বলেন, “যখন মানুষ একে অপরকে অমানুষ হিসেবে দেখছিল, যখন আত্মসমর্পণের বদলে আত্মহত্যা ছিল স্বাভাবিক—তখন এমন একটি ঘটনা মানবতার এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত।”
বছর পেরিয়ে গেলেও ঘটনাটি নতুন প্রজন্মের কাছে অজানা রয়ে গেছে। তবে স্থানীয় প্রবীণরা এখনও মনে রেখেছেন সেই দিনের নীরব সৈকত, যেখানে একবারের জন্য হলেও যুদ্ধ থেমেছিল মানবতার জন্য।



