যুক্তরাষ্ট্রের রাজনীতিতে দীর্ঘদিন ধরে ইসরায়েলপন্থী শক্তিশালী লবি গ্রুপগুলোর প্রভাব অস্বীকার করার উপায় নেই। বিশেষ করে আইপ্যাক (আমেরিকান ইসরায়েল পাবলিক অ্যাফেয়ার্স কমিটি) বহু বছর ধরে কংগ্রেসে ইসরায়েলপন্থী নীতিমালা জোরদারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। কিন্তু সাম্প্রতিক বছরগুলোতে মার্কিন ডেমোক্র্যাট নেতাদের অবস্থানে পরিবর্তন লক্ষ্য করা যাচ্ছে। একসময় এই সংগঠনের প্রতি নিঃশর্ত সমর্থন থাকলেও এখন ক্রমে তারা দূরে সরে যাচ্ছেন।
নিউইয়র্কের একজন প্রভাবশালী ডেমোক্র্যাট কংগ্রেস সদস্য দীর্ঘদিন ধরে মধ্যবামপন্থী সংগঠন ‘জে স্ট্রিট’-এর সঙ্গে সৌজন্যমূলক সম্পর্ক বজায় রেখেছিলেন, যারা মধ্যপ্রাচ্যে দ্বিরাষ্ট্রভিত্তিক সমাধানের পক্ষে কাজ করে। তবে এত বছরেও তিনি কখনোই তাদের আনুষ্ঠানিক সমর্থন নেননি। বরং তিনি ঘনিষ্ঠ ছিলেন কট্টর ইসরায়েলপন্থী আইপ্যাকের সঙ্গে, যারা তাঁকে দীর্ঘদিন অর্থনৈতিকভাবে সমর্থন দিয়েছে। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে সেই চিত্র বদলে যাচ্ছে। প্রথমবারের মতো তিনি ‘জে স্ট্রিট’-এর আনুষ্ঠানিক সমর্থন গ্রহণ করেছেন—যা মার্কিন রাজনীতিতে বড় এক পরিবর্তনের ইঙ্গিত দিচ্ছে।
এই পরিবর্তন কেবল একজন নেতার মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়। ক্যাপিটল হিলে এখন অনেক ডেমোক্র্যাট সদস্যই আইপ্যাক থেকে দূরে থাকছেন। গাজায় দীর্ঘমেয়াদি হামলা এবং ফিলিস্তিনিদের মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনাগুলো মার্কিন জনগণের মধ্যে ইসরায়েলবিরোধী মনোভাব বাড়িয়ে দিয়েছে। বিশেষত ডেমোক্র্যাট ভোটারদের মধ্যে ইসরায়েলের প্রতি সমর্থন দ্রুত হ্রাস পাচ্ছে। ফলে আইপ্যাক এখন অনেক নেতার কাছে একটি ‘টক্সিক ব্র্যান্ডে’ পরিণত হচ্ছে।
আগে কংগ্রেস সদস্যদের নির্বাচনী প্রচারে আইপ্যাক ছিল একটি গুরুত্বপূর্ণ অর্থায়নের উৎস। নতুন সদস্যদের জন্য তাদের বার্ষিক ইসরায়েল সফর ছিল এক প্রকার ঐতিহ্য। কিন্তু এখন এই সফরে অংশ নেওয়া ডেমোক্র্যাটদের সংখ্যা উল্লেখযোগ্যভাবে কমে গেছে। এমনকি যারা অতীতে নিয়মিত অংশ নিতেন, তারাও এবার যাননি। সম্প্রতি প্রথম মেয়াদে নির্বাচিত ৩৩ জন ডেমোক্র্যাট সদস্যের মধ্যে মাত্র ১১ জন ইসরায়েল সফরে অংশ নেন। অনেকে সফরের টিকিট কাটা থাকা সত্ত্বেও শেষ মুহূর্তে সরে দাঁড়ান।
সাম্প্রতিক সময়ে সিনেটেও পরিবর্তনের এই ছায়া পড়েছে। ডেমোক্র্যাটিক ককাসের অর্ধেকেরও বেশি সদস্য ইসরায়েলে অস্ত্র বিক্রি বন্ধের পক্ষে ভোট দিয়েছেন। কেউ কেউ প্রকাশ্যে বলেছেন, ইসরায়েল নির্দিষ্ট মানবাধিকার শর্ত পূরণ না করা পর্যন্ত তাদের কাছে বিশেষ ধরনের অস্ত্র বিক্রি সীমিত করা উচিত। এমনকি কয়েকজন ডেমোক্র্যাট নেতা এখন আইপ্যাকের কাছ থেকে আর অনুদান নেবেন না বলে ঘোষণা দিয়েছেন।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, এই পরিবর্তন কেবল কংগ্রেসের অভ্যন্তরীণ কোনো বিষয় নয়, বরং এটি জনমতের প্রতিফলন। বিভিন্ন জরিপে দেখা গেছে, যুক্তরাষ্ট্রে ইসরায়েলের প্রতি সমর্থন এখন অতীতের তুলনায় অনেক কম। গাজায় বেসামরিক মানুষের মৃত্যু ও দুর্ভিক্ষের খবর মার্কিন নাগরিকদের বিবেক নাড়া দিয়েছে। ফলে রাজনীতিকরাও বাধ্য হচ্ছেন নতুন বাস্তবতা স্বীকার করতে।
অন্যদিকে আইপ্যাক এখনো আগের অবস্থানেই অনড়। তারা গাজায় ইসরায়েলি সামরিক অভিযানকে হামাসের বিরুদ্ধে ‘ন্যায্য যুদ্ধ’ বলে দাবি করছে এবং বেসামরিক মৃত্যুর দায় সম্পূর্ণভাবে হামাসের ওপর চাপাচ্ছে। তবে এই যুক্তি এখন আর অনেক ডেমোক্র্যাট নেতাকে সন্তুষ্ট করতে পারছে না।
এক ডেমোক্র্যাট সিনেটর সম্প্রতি জানিয়েছেন, ইসরায়েলি প্রশাসনের নীতিতে কোনো পরিবর্তন না এলে তিনি প্রথমবারের মতো আইপ্যাকের সমর্থন পুনর্বিবেচনা করবেন। একই সঙ্গে অনেকেই জে স্ট্রিটের মতো তুলনামূলক উদার সংগঠনের সঙ্গে সম্পর্ক বাড়াচ্ছেন, যারা ইসরায়েল ও ফিলিস্তিন উভয়ের জন্য শান্তিপূর্ণ সমাধানের কথা বলে।
রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকদের মতে, এই পরিবর্তন মার্কিন রাজনীতিতে দীর্ঘমেয়াদে বড় প্রভাব ফেলতে পারে। বহু দশকের পুরোনো দ্বিদলীয় ঐকমত্য যেখানে ইসরায়েল ছিল ‘অচল সমর্থনের’ প্রতীক, সেখানে এখন নতুন এক বাস্তবতা তৈরি হচ্ছে। ভবিষ্যতে এই পরিবর্তন যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রনীতি এবং মধ্যপ্রাচ্যে তাদের অবস্থানেও প্রভাব ফেলতে পারে।



