Thursday, November 20, 2025
spot_img
Homeআন্তর্জাতিকমোসাদ: রহস্য, ভয় আর টার্গেট কিলিংয়ের গোপন জগৎ

মোসাদ: রহস্য, ভয় আর টার্গেট কিলিংয়ের গোপন জগৎ

ইসরায়েলের কুখ্যাত গোয়েন্দা সংস্থা মোসাদ বহু দশক ধরে বিশ্বের নানা প্রান্তে রহস্য, ভয় এবং বিতর্কের প্রতীক হয়ে আছে। কখনো তারা প্রতিপক্ষ দেশের গুরুত্বপূর্ণ নেতাদের হত্যায় আলোচনায় এসেছে, আবার কখনো ব্যর্থ অভিযানে সমালোচনার মুখে পড়েছে। হামাস থেকে ইরান পর্যন্ত, মধ্যপ্রাচ্যে মোসাদের ছায়া সর্বত্রই বিস্তৃত।

গত বছর হামাসের রাজনৈতিক শাখার প্রধানকে হত্যা, ২০২০ সালে ইরানের শীর্ষ পরমাণুবিজ্ঞানীকে অভিনব কায়দায় খুন, এবং সম্প্রতি ইরানের অভ্যন্তরে সামরিক কর্মকর্তাদের একযোগে হত্যা—সব কিছুর পেছনে ঘুরে ফিরে এসেছে মোসাদের নাম। কিন্তু একইসঙ্গে তারা নিজ দেশে হামাসের আকস্মিক হামলা ঠেকাতে ব্যর্থ হয়।

রহস্যময় শুরু ও গোপন ইতিহাস

ইসরায়েল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার দেড় বছর পর, ১৯৪৯ সালের ডিসেম্বরে মোসাদের আনুষ্ঠানিক যাত্রা শুরু হয়। তাদের মূল দায়িত্ব বিদেশি হুমকি থেকে ইসরায়েলকে রক্ষা করা এবং দেশের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখা। শুরুর দিকেই এই সংস্থা নিজেদের পরিচয় গোপন রেখে এমন সব অভিযান চালিয়েছে, যা চলচ্চিত্রকেও হার মানায়।

ইতিহাসে অন্যতম আলোচিত মোসাদ এজেন্ট এলি কোহেন ছদ্মনাম “কামেল আমিন সাবেত” নিয়ে সিরিয়ার সরকার ও সেনাবাহিনীর শীর্ষ পর্যায়ে অনুপ্রবেশ করেন। পার্টি ও মেলামেশার আড়ালে তিনি রাষ্ট্রীয় গোপন তথ্য সংগ্রহ করতেন এবং সেগুলো ইসরায়েলে পাঠাতেন। শেষ পর্যন্ত ধরা পড়ে মৃত্যুদণ্ড পান, কিন্তু তাঁর পাঠানো তথ্য দিয়েই ১৯৬৭ সালের ছয় দিনের যুদ্ধে ইসরায়েল সিরিয়াকে পরাজিত করতে সক্ষম হয়।

কুখ্যাতি ও সাফল্যের ইতিহাস

মোসাদের ইতিহাসে সবচেয়ে আলোচিত অভিযানগুলোর একটি হলো নাৎসি কর্মকর্তা অ্যাডলফ আইখম্যানকে খুঁজে বের করে আর্জেন্টিনা থেকে গোপনে ইসরায়েলে নিয়ে আসা। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে লক্ষাধিক ইহুদির হত্যার অন্যতম স্থপতি ছিলেন আইখম্যান।

আরেকটি ঐতিহাসিক অভিযান ছিল ১৯৭৬ সালের উগান্ডার এন্টাবি অভিযান। ছিনতাই হওয়া উড়োজাহাজের শতাধিক ইহুদি যাত্রীকে মুক্ত করতে মোসাদের সহযোগিতায় ইসরায়েলি সেনারা দুঃসাহসিক উদ্ধার অভিযান চালায়। এ অভিযানে ইসরায়েলের বর্তমান প্রধানমন্ত্রীর ভাই নিহত হন, যিনি নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন ঐ মিশন।

১৯৮০ সালে ‘অপারেশন ব্রাদার্স’ নামে সুদানের ভেতর দিয়ে গোপনে সাত হাজার ইথিওপীয় ইহুদিকে উদ্ধার করা হয়। এ ঘটনা পরে নেটফ্লিক্সে ‘রেড সি ডাইভিং’ নামে সিরিজে চিত্রিত হয়। এছাড়া ১৯৭২ সালের মিউনিখ অলিম্পিকে ইসরায়েলি খেলোয়াড়দের হত্যার প্রতিশোধ নিতে ‘ব্ল্যাক সেপ্টেম্বর’ দলের সদস্যদের একে একে হত্যা করে মোসাদ।

এমনকি আধুনিক যুগেও তাদের কার্যক্রম থেমে নেই। ২০১০ সালে দুবাইয়ের এক হোটেলে হামাসের জ্যেষ্ঠ নেতাকে হত্যা, ২০২3 সালে লেবাননে হিজবুল্লাহ নেতাদের পেজার বিস্ফোরণে মৃত্যু, এবং একই বছরে ইরানে অতিথিশালায় হামাস প্রধানকে হত্যা—সবই মোসাদের কৌশলের নিদর্শন।

মোসাদের ব্যর্থতা ও সমালোচনা

যেমন সাফল্যের গল্প আছে, তেমনি রয়েছে ব্যর্থতার ইতিহাসও। ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর হামাসের আকস্মিক হামলা ইসরায়েলের ইতিহাসে গোয়েন্দা ব্যর্থতার সবচেয়ে বড় উদাহরণ। মিসর আগেই সতর্ক করলেও, ইসরায়েল বিষয়টিকে গুরুত্ব দেয়নি। ফলে সেই হামলায় ১,২০০ মানুষ নিহত এবং শতাধিক ইসরায়েলি বন্দী হয়।

এছাড়া ১৯৯৭ সালে হামাসের নেতা খালেদ মেশালকে বিষ প্রয়োগে হত্যার চেষ্টা করলেও, সেই অভিযানও ব্যর্থ হয়। মোসাদের এই ব্যর্থতাগুলো প্রমাণ করে, যতই প্রযুক্তি ও কৌশল থাকুক, গোয়েন্দা জগতেও নিখুঁততা সবসময় সম্ভব নয়।

রহস্যে মোড়া এই বাহিনীর ভবিষ্যৎ

মোসাদের বর্তমান প্রধান ডেভিড বার্নিয়া, যিনি সরাসরি ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রীকে রিপোর্ট করেন। ইসরায়েলে প্রধানমন্ত্রী ছাড়াও সবচেয়ে ক্ষমতাধর ব্যক্তি হিসেবে মোসাদ প্রধানের ভূমিকা স্পষ্ট। তবে এ সংস্থার কাজের ধরন, এজেন্টদের পরিচয়, কিংবা তাদের গোপন অভিযানের সঠিক বিবরণ আজও রহস্যের আড়ালে।

ইসরায়েল মোসাদের মাধ্যমে প্রতিপক্ষের উপর গোয়েন্দা নজরদারি চালিয়ে আসছে কয়েক দশক ধরে। কিন্তু প্রতিটি অভিযানের পর প্রশ্ন ওঠে—রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তার নামে এ ধরনের টার্গেট কিলিং বা গুপ্ত হত্যা কতটা ন্যায্য?

ইতিহাসে মোসাদ একদিকে যেমন ভয় ও দক্ষতার প্রতীক, অন্যদিকে তেমনি মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগে অভিযুক্ত। রহস্য, ভয়, সাফল্য ও ব্যর্থতার মিশেলে আজও মোসাদ এক অন্ধকারাচ্ছন্ন কিংবদন্তি।

RELATED ARTICLES

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

- Advertisment -
Google search engine

Most Popular

Recent Comments