বিশ্বজুড়ে নারীদের নিরাপত্তা ও মর্যাদার প্রশ্ন আজও সমানভাবে প্রাসঙ্গিক। বিশেষ করে যখন সমাজের সর্বোচ্চ অবস্থানে থাকা কোনো নারীও যৌন নিপীড়নের শিকার হন, তখন তা শুধু একটি ঘটনা নয়, বরং নারীর নিরাপত্তা সম্পর্কে গভীর সংকেত বহন করে।
সম্প্রতি মেক্সিকোর প্রেসিডেন্টের সঙ্গে ঘটে যাওয়া এক ভয়াবহ ঘটনা দেশটির সমাজে ও আন্তর্জাতিক পরিসরে তীব্র প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করেছে। রাজধানীর রাস্তায় নাগরিকদের সঙ্গে কথা বলার সময় এক মাতাল ব্যক্তি আচমকা তাঁর গলায় চুমু খাওয়ার চেষ্টা করে এবং বুকের কাছে হাত দেয়। এই দৃশ্য ক্যামেরায় ধরা পড়ে, যা প্রমাণ করে — ক্ষমতা বা মর্যাদা কোনো নারীকে যৌন হয়রানি থেকে রক্ষা করতে পারে না। নারী মানেই আজও অনেকের কাছে সহজ লক্ষ্য।
প্রেসিডেন্ট নিজেও পরে মন্তব্য করেছেন, “যদি দেশের সর্বোচ্চ পদে থাকা একজন নারী এই ধরনের অপমানের শিকার হন, তাহলে সাধারণ তরুণী বা নারী কর্মীরা কতটা ঝুঁকিতে আছেন, তা সহজেই অনুমান করা যায়।”
সরকারি পরিসংখ্যান অনুযায়ী, মেক্সিকোতে প্রতি পাঁচজন নারী বা কিশোরীর একজন গত এক বছরে সমাজে কোনো না কোনো ধরনের যৌন সহিংসতার শিকার হয়েছেন। প্রতিদিন গড়ে ১০ জন নারী হত্যার শিকার হন। দীর্ঘদিন ধরেই দেশটি ‘মাচিজমো’ বা পুরুষতান্ত্রিক মানসিকতার জন্য কুখ্যাত। তবে এই সমস্যা শুধু মেক্সিকোতেই সীমাবদ্ধ নয়। যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যের বিভিন্ন জরিপেও দেখা গেছে, চারজন নারীর মধ্যে তিনজন কখনো না কখনো যৌন হয়রানির শিকার হয়েছেন।
শীর্ষ পর্যায়ের নারীদের বিরুদ্ধে এই ধরনের হামলা শুধু তাদের ব্যক্তিগত ক্ষতি নয়, বরং একটি ভয়ঙ্কর বার্তা — নারী যত বড় অর্জনই করুক, শেষ পর্যন্ত তাকে শরীরের মধ্যেই সীমাবদ্ধ করে দেখা হয়। এই মানসিকতা বিশ্বের বিভিন্ন দেশে রাজনীতি ও নেতৃত্বের ক্ষেত্রেও স্পষ্ট।
অস্ট্রেলিয়ার সাবেক প্রধানমন্ত্রীকে একসময় “সন্তানহীন নারী” বলে অপমান করা হয়েছিল। যুক্তরাষ্ট্রের ভাইস প্রেসিডেন্টও বারবার যৌন ইঙ্গিতপূর্ণ কটূক্তির শিকার হয়েছেন। যুক্তরাজ্যের দুই নারী নেত্রীর বৈঠক নিয়েও সংবাদপত্রে প্রকাশিত হয় ‘দেহভিত্তিক’ শিরোনাম। এতে বোঝা যায়, নারীরা শুধু রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের নয়, বরং লিঙ্গভিত্তিক বৈষম্যেরও শিকার।
‘রেইকজাভিক ইনডেক্স ফর লিডারশিপ’-এর সাম্প্রতিক জরিপ বলছে, যুক্তরাষ্ট্রে অর্ধেকেরও কম মানুষ নারী রাজনৈতিক নেতৃত্বকে পুরোপুরি স্বস্তিদায়ক মনে করেন। সমাজে এই মানসিকতা যতদিন থাকবে, ততদিন নারীর জন্য সমান নিরাপত্তা অর্জন কঠিন হয়ে থাকবে।
প্রেসিডেন্ট ইতোমধ্যেই হামলাকারীর বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন এবং দেশব্যাপী যৌন হয়রানিকে অপরাধ হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন। যদিও অতীতে নারী অধিকার কর্মীদের কিছু আন্দোলনে প্রশাসনিক কড়াকড়ি আরোপের কারণে তাঁর নেতৃত্ব নিয়েও প্রশ্ন উঠেছিল, তবু এই ঘটনার পর তাঁর অবস্থানকে অনেকেই নারীর মর্যাদা রক্ষার সাহসী পদক্ষেপ হিসেবে দেখছেন।
এটি প্রমাণ করে, নারী নেতৃত্ব সবসময় নারীর নিরাপত্তা নিশ্চিত করে না, কিন্তু কোনো নারী নেতা যখন এই ধরনের অপমানের বিরুদ্ধে দাঁড়ান, তখন তা সমাজে গুরুত্বপূর্ণ বার্তা দেয়।
এখন সময় এসেছে সরকার ও নারী অধিকার সংগঠনগুলোকে একসঙ্গে কাজ করার, যাতে সহিংসতা ও নারীবিদ্বেষের শেকল ছিন্ন করে একটি নিরাপদ সমাজ গড়া যায়—যেখানে কোনো নারী, যেকোনো পদে থেকেই নিজেকে নিরাপদ মনে করবেন।



