বিশ্বের উচ্চশিক্ষা ও চাকরির বাজারে বড় পরিবর্তনের ইঙ্গিত মিলছে সাম্প্রতিক এক গবেষণায়। গবেষণায় দেখা গেছে, বহু বছর ধরে মর্যাদার প্রতীক হিসেবে বিবেচিত কিছু ডিগ্রি দ্রুত বাজারে তাদের মূল্য হারাচ্ছে। এখন আর শুধুমাত্র ডিগ্রি থাকলেই চাকরির নিশ্চয়তা মিলছে না—চাকরিদাতারা এখন খুঁজছেন বাস্তব দক্ষতা, অভিযোজনক্ষমতা এবং প্রযুক্তিগত জ্ঞানসম্পন্ন কর্মী।
গবেষণাটি প্রকাশ করে যে, কর্মক্ষেত্রের বাস্তবতা বদলে যাওয়ায় শিক্ষার্থীদের পড়াশোনার ধরনও বদলাতে হবে। ভবিষ্যতের চাকরির বাজারে টিকে থাকতে হলে শুধু একক ডিগ্রি নয়, বরং বহুমাত্রিক দক্ষতা অর্জনই হবে মূল চাবিকাঠি।
গবেষণার তথ্য বলছে, ২০২০ সালে ডেভিড ডেমিং ও কাদেম নোরে পরিচালিত এক বিশ্লেষণে দেখা যায়, প্রযুক্তিনির্ভর কিছু ডিগ্রির প্রাথমিক আয়ের হার বেশি হলেও সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সেই সুবিধা হারিয়ে যায়। কারণ, প্রযুক্তির উন্নতির সঙ্গে অনেক দক্ষতা দ্রুত অপ্রচলিত হয়ে পড়ে।
একইসঙ্গে ২০২৫ সালের শুরুর দিকের একটি বিশ্লেষণে বলা হয়, এমনকি এমবিএর মতো মর্যাদাপূর্ণ ডিগ্রিধারীরাও এখন আর আগের মতো সহজে শীর্ষ পদে পৌঁছাতে পারছেন না। এটি ইঙ্গিত দিচ্ছে যে, ঐতিহ্যবাহী ডিগ্রিগুলোর বাজারমূল্য ধীরে ধীরে হ্রাস পাচ্ছে।
শিক্ষাক্ষেত্রের বিশেষজ্ঞরা জানান, মানবিক ও সামাজিক বিজ্ঞান শাখায় ভর্তি কমে যাওয়ার অন্যতম কারণ হচ্ছে এর সরাসরি চাকরির সুযোগ কমে যাওয়া। শিক্ষার্থীরা এখন এমন বিষয়ের দিকে ঝুঁকছেন, যেখানে ভবিষ্যৎ ক্যারিয়ারপথ স্পষ্ট এবং প্রযুক্তিনির্ভর দক্ষতা অর্জনের সুযোগ রয়েছে।
গবেষণায় বাজারমূল্য হারানো ১০টি ডিগ্রি উল্লেখ করা হয়েছে—
প্রথমত, বিজনেস অ্যাডমিনিস্ট্রেশন (এমবিএসহ)—বাজারে অতিরিক্ত স্নাতক এবং পরিবর্তিত নিয়োগপ্রবণতার কারণে আয় কমছে।
দ্বিতীয়ত, কম্পিউটার সায়েন্স—প্রারম্ভিক আয়ের সুযোগ থাকলেও প্রযুক্তির দ্রুত অগ্রগতিতে দক্ষতা অপ্রচলিত হয়ে পড়ছে।
তৃতীয়ত, মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং—অটোমেশন ও বিদেশভিত্তিক উৎপাদনের কারণে কর্মসংস্থানের সুযোগ কমছে।
চতুর্থ, অ্যাকাউন্টিং—কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ও অটোমেশন দীর্ঘমেয়াদে চাকরি কমিয়ে দিচ্ছে।
পঞ্চম, বায়োকেমিস্ট্রি—এই বিষয়ের চাকরির ক্ষেত্র সীমিত এবং একাডেমিক নির্ভরতা বেশি।
ষষ্ঠ, সাইকোলজি (স্নাতক)—উচ্চতর ডিগ্রি ছাড়া সরাসরি চাকরির সুযোগ সীমিত।
সপ্তম, ইংরেজি ও হিউম্যানিটিজ—চাকরির অনিশ্চয়তায় ভর্তি কমছে।
অষ্টম, সোশিওলজি ও সামাজিক বিজ্ঞান—শিক্ষার বিষয়বস্তু কর্মক্ষেত্রের বাস্তবতার সঙ্গে সরাসরি সম্পর্কিত নয়।
নবম, ইতিহাস—ক্যারিয়ারের মধ্যবর্তী পর্যায়ে আয়ের হার উল্লেখযোগ্যভাবে কমে যায়।
দশম, দর্শন—চিন্তাশক্তি মূল্যবান হলেও এর সরাসরি প্রয়োগ সীমিত।
গবেষণায় আরও বলা হয়, এখনকার শিক্ষা ব্যবস্থায় সফল হতে হলে একক ডিগ্রির ওপর নির্ভর না করে প্রযুক্তিগত জ্ঞান, সৃজনশীলতা ও সামাজিক দক্ষতার সমন্বয় জরুরি। বিশেষ করে ডেটা সায়েন্স, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, ডিজিটাল মার্কেটিং, পরিবেশবিজ্ঞান, হেলথ সায়েন্স ও উদ্যোক্তা শিক্ষার মতো ক্ষেত্রগুলো ভবিষ্যতে সবচেয়ে চাহিদাসম্পন্ন হবে।
একইসঙ্গে ২০২৫ সালের ‘স্টুডেন্ট চয়েজ’ প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, প্রকৌশল, কম্পিউটার সায়েন্স ও নার্সিংয়ের মতো পেশাগত বিষয়গুলোর বিনিয়োগে এখনো ভালো রিটার্ন পাওয়া যায়। তবে সৃজনশীল চিন্তা ও সমালোচনামূলক বিশ্লেষণ ক্ষমতা যুক্ত হলে শিক্ষার্থীরা আরও প্রতিযোগিতামূলক হয়ে উঠতে পারে।
গবেষণার সারসংক্ষেপে বলা হয়েছে—ডিগ্রি এখনও গুরুত্বপূর্ণ, তবে তার অর্থ বদলে গেছে। এখনকার পৃথিবীতে অভিযোজনযোগ্যতা, প্রযুক্তির ব্যবহার এবং মানবিক বুদ্ধিমত্তার সমন্বয়ই নির্ধারণ করবে কে কতটা সফল হবে। একক ডিগ্রির যুগ শেষ—এখন সময় অবিরাম শেখা এবং দক্ষতা আপডেট রাখার।



