Sunday, October 5, 2025
spot_img
Homeএডুকেশনমার্কিন শুল্কনীতি ও বৈশ্বিক অর্থনীতির নতুন সংকট

মার্কিন শুল্কনীতি ও বৈশ্বিক অর্থনীতির নতুন সংকট

বর্তমানে বিশ্ববাণিজ্য ব্যবস্থা এক নতুন চ্যালেঞ্জের মুখে দাঁড়িয়েছে। প্রচলিত মুক্তবাণিজ্যের ধারণা এখন প্রশ্নবিদ্ধ। এর মূলে রয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সাম্প্রতিক বাণিজ্যনীতি, যা শুধু মার্কিন অর্থনীতি নয়, বরং বিশ্বজুড়ে, বিশেষ করে উন্নয়নশীল দেশগুলোতে, এক ধরনের অনিশ্চয়তা সৃষ্টি করেছে।

২০২৫ সালের এপ্রিলে ট্রাম্প ‘রেসিপ্রোকাল ট্যারিফ’ নামে একটি নতুন শুল্কনীতি ঘোষণা করেন। এর মূল উদ্দেশ্য হলো যুক্তরাষ্ট্রের দেশীয় শিল্পকে সুরক্ষা দেওয়া, বাণিজ্য ঘাটতি কমানো এবং ‘অন্যায্য বিদেশি বাণিজ্য’ প্রতিরোধ করা। ট্রাম্প প্রশাসনের দীর্ঘদিনের অভিযোগ ছিল যে, বহু দেশ যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে অবাধে পণ্য রপ্তানি করলেও, মার্কিন পণ্যের ওপর উচ্চ শুল্ক আরোপ করে অসম বাণিজ্য সম্পর্ক বজায় রাখছে।

চীন-মার্কিন বাণিজ্যযুদ্ধ ও বৈশ্বিক প্রভাব
‘রেসিপ্রোকাল ট্যারিফ’ নীতির সবচেয়ে বড় প্রভাব পড়েছে মার্কিন-চীন বাণিজ্য সম্পর্কের ওপর। ২০১৮ সালে ট্রাম্পের প্রথম মেয়াদে শুরু হওয়া এই বাণিজ্যযুদ্ধ বর্তমানেও চলমান। যুক্তরাষ্ট্রের অভিযোগ ছিল যে, চীন মেধাস্বত্ব চুরি, রাষ্ট্রীয় ভর্তুকি এবং বাজারে প্রবেশাধিকারের ক্ষেত্রে বাধা তৈরি করে নিজেদের বাণিজ্যিক সুবিধা বাড়াচ্ছে। এর জবাবে যুক্তরাষ্ট্র চীনা পণ্যের ওপর ১০০ শতাংশ পর্যন্ত শুল্ক আরোপ করে, যার পাল্টা জবাবে চীনও মার্কিন কৃষি পণ্যের ওপর শুল্ক বসায়। যদিও ট্রাম্প প্রশাসনের দাবি ছিল এর ফলে মার্কিন শিল্প পুনরুজ্জীবিত হবে, তবে বাস্তবে এর মিশ্র প্রভাব দেখা গেছে। অনেক মার্কিন কোম্পানি উৎপাদন খরচ বৃদ্ধি এবং চীনা বাজার হারানোর মতো সমস্যার সম্মুখীন হয়েছে।

নতুন শুল্কনীতি এবং বাংলাদেশের চ্যালেঞ্জ
নতুন নীতি অনুযায়ী, সব ধরনের আমদানির ওপর প্রাথমিকভাবে ১০ শতাংশ হারে শুল্ক আরোপ করা হয়েছে। এর চেয়েও বড় কথা, যেসব দেশের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের বড় বাণিজ্য উদ্বৃত্ত রয়েছে, তাদের ওপর আলাদা করে অতিরিক্ত শুল্ক ধার্য করা হচ্ছে। এটি বিশ্বজুড়ে বাণিজ্য অংশীদারদের মধ্যে এক ধরনের আতঙ্ক তৈরি করেছে। এই নীতি বৈশ্বিক বাণিজ্যকে সংকুচিত করতে পারে এবং সরবরাহ শৃঙ্খলে বড় ধরনের ব্যাঘাত ঘটাতে পারে, যার ফলে পণ্যের দাম বৃদ্ধি পাবে।

যদিও যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাংলাদেশের বাণিজ্য তুলনামূলকভাবে কম, তবু বাংলাদেশ এই শুল্কের কারণে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোর একটি। প্রস্তাবিত ৩৭ শতাংশ শুল্ক থেকে নতুন হার কিছুটা কম হলেও, এটি ভিয়েতনাম বা অন্যান্য দেশের তুলনায় অনেক বেশি। এতে বাংলাদেশের রপ্তানিকারকরা উদ্বিগ্ন, কারণ তৈরি পোশাকসহ বিভিন্ন পণ্য রপ্তানির মাধ্যমে বাংলাদেশ প্রতি বছর প্রায় ৮.৪০ বিলিয়ন ডলার আয় করে। এই শুল্কের ফলে রপ্তানি আয়ে ধস নামলে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ এবং দেশের সামষ্টিক অর্থনীতিতে বড় চাপ সৃষ্টি হতে পারে। সবচেয়ে বড় উদ্বেগের বিষয় হলো কর্মসংস্থান, কারণ বাংলাদেশের তৈরি পোশাক খাত দেশের অর্থনীতির মেরুদণ্ড এবং লাখ লাখ মানুষের কর্মসংস্থানের উৎস।

সঙ্কট থেকে উত্তরণের পথ
এই সংকট মোকাবিলায় বাংলাদেশকে বেশ কিছু পদক্ষেপ নিতে হবে:

১. বাজার বহুমুখীকরণ: মার্কিন বাজারের ওপর অতিরিক্ত নির্ভরতা কমিয়ে ইউরোপ, জাপান, কানাডা এবং অন্যান্য উদীয়মান বাজারগুলোতে প্রবেশাধিকার বাড়াতে হবে।

২. পণ্য বহুমুখীকরণ: তৈরি পোশাকের বাইরে ফার্মাসিউটিক্যালস, আইটি পরিষেবা এবং অন্যান্য সম্ভাবনাময় খাতে রপ্তানি বাড়াতে মনোযোগ দিতে হবে।

৩. দক্ষতা বৃদ্ধি: উৎপাদন খরচ কমানো এবং প্রতিযোগিতায় টিকে থাকার জন্য আধুনিক প্রযুক্তি ও স্বয়ংক্রিয়তা ব্যবহার করে উৎপাদনশীলতা বাড়াতে হবে।

৪. বাণিজ্য কূটনীতি জোরদার: যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে শুল্ক কমানোর জন্য দ্বিপাক্ষিক আলোচনা চালিয়ে যেতে হবে এবং অন্যান্য দেশের সঙ্গে মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি (FTA) বা অগ্রাধিকারমূলক বাণিজ্য চুক্তি (PTA) স্বাক্ষরের প্রক্রিয়া দ্রুত করতে হবে।

৫. দেশীয় বাজার শক্তিশালীকরণ: রপ্তানির পাশাপাশি অভ্যন্তরীণ চাহিদা পূরণের জন্য দেশীয় শিল্পের সক্ষমতা বাড়াতে হবে, যা বৈশ্বিক বাণিজ্য সংকটের প্রভাব কমাতে সাহায্য করবে।

পরিশেষে বলা যায়, ট্রাম্পের নতুন শুল্কনীতি বিশ্ববাণিজ্যকে এক নতুন সংকটে ঠেলে দিয়েছে। বাংলাদেশের জন্য এটি একটি বড় চ্যালেঞ্জ হলেও, সঠিক কৌশল অবলম্বন করলে এই সংকটকে একটি সুযোগে পরিণত করা সম্ভব।

RELATED ARTICLES

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

- Advertisment -
Google search engine

Most Popular

Recent Comments