Thursday, November 20, 2025
spot_img
Homeভ্রমণ টুকিটাকিমহাশূন্য থেকে আসা পাথর, আজ পর্যটকদের মুগ্ধতার পাহাড়

মহাশূন্য থেকে আসা পাথর, আজ পর্যটকদের মুগ্ধতার পাহাড়

অতল মহাশূন্য থেকে প্রায় ৩০ কোটি বছর আগে পৃথিবীর বুকে নেমে এসেছিল এক বিশাল পাথরখণ্ড। সেই অতিকায় গ্রানাইট এখন দাঁড়িয়ে আছে ইতিহাস, প্রকৃতি ও সংস্কৃতির এক জীবন্ত সাক্ষী হয়ে। এই বিশাল শিলা-পাহাড় আজ বিশ্বের অন্যতম জনপ্রিয় পর্যটনকেন্দ্র—স্টোন মাউন্টেইন।

আমাদের গাড়ি যতই কাছে এগোচ্ছে, ততই চোখের সামনে বড় হয়ে উঠছে অতিকায় ধূসর পাহাড়টি। নিচে নেমে দেখি গাছপালা, সবুজ ঘাসের প্রান্তর আর ছোট ছোট জলাশয়—এক অদ্ভুত শান্ত পরিবেশ। কোথাও দু’টি হরিণ নির্বিকারভাবে ঘাস খাচ্ছে, যেন মানুষ দেখায় তাদের আর কোনো কৌতূহল নেই।

অনেকে ভাবে পাথরের পাহাড় মানে রুক্ষ ও প্রাণহীন কিছু, কিন্তু স্টোন মাউন্টেইনে এসে সেই ধারণা ভেঙে যায়। প্রকৃতি এখানে পাথরের বুকেও লাবণ্য ছড়িয়ে দিয়েছে। পাহাড়টি আসলে একটিমাত্র বিশাল গ্রানাইট শিলা, পৃথিবীর বৃহত্তম একক গঠনগুলোর একটি। ইতিহাস বলছে, মহাশূন্য থেকে নেমে আসা এই পাথর পৃথিবীতে আঘাত হেনে তৈরি করেছে আজকের এই বিস্ময়কর পাহাড়।

চিন্তা করতেই অবাক লাগে—মানবসভ্যতার অনেক আগেই জন্ম নেয়া এই পাথরের ওপর আজ মানুষ দাঁড়িয়ে উপভোগ করছে তার সৌন্দর্য। মনে হয়, ইতিহাস ও প্রকৃতি এখানে পাশাপাশি দাঁড়িয়ে আছে। দূর থেকে কঠিন ও নীরব মনে হলেও কাছে গিয়ে দেখা যায়—এই পাথর যেন জীবন্ত, নিঃশব্দে কিছু বলছে।

ইতিহাসের ছাপ পাহাড়ের গায়ে

স্টোন মাউন্টেইন শুধু প্রকৃতির নয়, ইতিহাসেরও এক বড় অংশ। পাহাড়ের গায়ে খোদাই করে তৈরি করা হয়েছে তিন বিশাল ব্যক্তিত্বের ভাস্কর্য, যারা একসময় গৃহযুদ্ধের সঙ্গে জড়িয়ে ছিলেন। ১৮৬১ থেকে ১৮৬৫ সালের মধ্যে আমেরিকার উত্তর ও দক্ষিণের রাজ্যগুলোর মধ্যে যে গৃহযুদ্ধ হয়েছিল, তার মূল কারণ ছিল দাসপ্রথা। উত্তরের রাজ্যগুলো দাসপ্রথা বিলুপ্ত করতে চাইলেও দক্ষিণের রাজ্যগুলো চেয়েছিল তা বজায় রাখতে। অবশেষে যুদ্ধে জয় পায় উত্তরাঞ্চল, আর বিলুপ্ত হয় দাসপ্রথা।

তবে ইতিহাসের খলনায়কদের নাম ভোলেনি কেউ; তাদের ভাস্কর্য খোদাই করা হয়েছে পাহাড়ের গায়ে, যা এখন সেই অন্ধকার অতীতের নীরব সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে।

রঙিন আলোয় জীবন্ত হয়ে ওঠে পাথর

দিনে এই পার্ক প্রকৃতির আশ্রয়স্থল, হ্রদ, সবুজ মাঠ, আর কেব্‌ল কারের রোমাঞ্চে মুখর থাকে। আর সন্ধ্যা নামলেই পাহাড়ের গায়ে শুরু হয় লেজার শো—রঙিন আলো, ইতিহাস ও সঙ্গীতের মিশ্রণে যেন জীবন্ত হয়ে ওঠে অতীত। আলোর রশ্মি, শব্দ ও গল্পের সুরে পাহাড়টিতে তৈরি হয় এক মায়াময় পরিবেশ।

পাহাড়ের নিচে রয়েছে একটি মেমোরিয়াল মিলনায়তন, যেখানে দেয়ালে টাঙানো আছে যুদ্ধের স্মারক, পুরোনো নথি আর ঐতিহাসিক ছবিগুলো। মাঝে মাঝে এখানে আয়োজন করা হয় সংগীতানুষ্ঠান ও প্রামাণ্যচিত্র প্রদর্শনী, যা পর্যটকদের ইতিহাসের ভেতরে নিয়ে যায়।

ওপরে ওঠার রোমাঞ্চ

পাহাড়ে ওঠার দুটি পথ—পায়ে হেঁটে বা কেব্‌ল কারে। আমরা কেব্‌ল কারে উঠলাম। জানালা দিয়ে দেখা গেল নিচের দুনিয়া ক্রমেই ছোট হয়ে যাচ্ছে, গাছগুলো যেন ক্ষুদ্র বনসাই হয়ে উঠছে। ধীরে ধীরে চোখের সামনে খুলে গেল বিশাল আটলান্টার দৃশ্য। ভয় ও রোমাঞ্চ একসঙ্গে মিশে এক অদ্ভুত অনুভূতি তৈরি করল।

চূড়ায় উঠে মনে হলো, যেন অন্য কোনো গ্রহে এসে পড়েছি। চারদিকে খাঁজকাটা পাথরের সমতল, তবে ফাঁকে ফাঁকে জন্ম নিয়েছে ছোট গাছ, ফুটেছে রঙিন ফুল। ১,৬৮৬ ফুট উচ্চতায় প্রকৃতির এই রূপ মন ছুঁয়ে যায়। সূর্য যখন অস্ত যাচ্ছে, তখন পাথরের গায়ে লাল আভা ছড়িয়ে পড়েছে—একটা অপার্থিব দৃশ্য।

পাথরের ফাঁকে ফুটে থাকা ছোট ফুল, কিছু বড় গাছ, আর ঠান্ডা বাতাস যেন মনে করিয়ে দেয়—জীবন সব জায়গায় পথ খুঁজে নেয়। মনে হয়, এই বিশাল পাথর নিঃশব্দে পৃথিবীকে পাহারা দিচ্ছে যুগের পর যুগ।

তবে এই পাহাড় একসময় ছিল ভয়ের স্থানও। স্থানীয়দের মুখে শোনা যায়, একসময়ে এখানে বর্ণবাদী সংগঠন তাদের নিষ্ঠুর কর্মকাণ্ড চালাত। এখন সেই অন্ধকার ইতিহাস মুছে গেছে, কিন্তু পাথরের গায়ে যেন আজও রক্তিম সূর্যের আলোয় ইতিহাসের দাগ জ্বলজ্বল করে।

স্টোন মাউন্টেইন তাই শুধু একটি পর্যটনকেন্দ্র নয়—এটি সময়, ইতিহাস ও প্রকৃতির এক অপার মেলবন্ধন।

RELATED ARTICLES

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

- Advertisment -
Google search engine

Most Popular

Recent Comments