Thursday, November 20, 2025
spot_img
Homeপ্রযুক্তি জগৎমহাবিশ্বকে ‘নীল বিন্দু’ হিসেবে দেখা সেই বিজ্ঞানীর উত্তরাধিকার

মহাবিশ্বকে ‘নীল বিন্দু’ হিসেবে দেখা সেই বিজ্ঞানীর উত্তরাধিকার

জ্যোতির্বিজ্ঞানের ইতিহাসে এমন কিছু নাম আছে, যারা শুধু বিজ্ঞানের সীমানাতেই সীমাবদ্ধ থাকেননি—তাদের চিন্তা, কল্পনা ও উপস্থাপনা সাধারণ মানুষকেও মহাবিশ্বের সৌন্দর্যের সঙ্গে যুক্ত করেছে। এমনই এক অনন্য ব্যক্তিত্ব ছিলেন বিখ্যাত জ্যোতির্বিজ্ঞানী ও বিজ্ঞান প্রচারক, যিনি মানবজাতিকে প্রথমবারের মতো মহাবিশ্বে নিজেদের ক্ষুদ্রতা ও গুরুত্বের গভীর উপলব্ধি এনে দিয়েছিলেন। তিনি জন্মগ্রহণ করেন ১৯৩৪ সালের ৯ নভেম্বর, এবং বিজ্ঞানের জটিল ধারণাগুলোকে সহজ, কাব্যিক ও হৃদয়স্পর্শী ভাষায় প্রকাশ করার মাধ্যমে বিশ্বজুড়ে খ্যাতি অর্জন করেন।

বিজ্ঞানকে সাধারণ মানুষের কাছে সহজভাবে উপস্থাপন করাই ছিল তাঁর সবচেয়ে বড় অবদান। টেলিভিশন সিরিজ, বই ও গবেষণার মাধ্যমে তিনি বিজ্ঞানের বিমূর্ত ধারণাগুলোকে এমনভাবে তুলে ধরেছেন, যা যেমন শিক্ষণীয়, তেমনি কল্পনাময়। ১৯৮০ সালে প্রচারিত তাঁর বিখ্যাত টেলিভিশন সিরিজ ‘কসমস: এ পার্সোনাল ভয়েজ’ কোটি দর্শককে মহাবিশ্বের রহস্যের প্রতি আগ্রহী করে তোলে। বিজ্ঞানের বিষয়গুলোকে গল্পের ছলে উপস্থাপন করার জন্য তিনি সবার কাছে হয়ে ওঠেন ‘বিজ্ঞান কথক’। তাঁর একটি বিখ্যাত উক্তি আজও বিজ্ঞানমনস্কদের অনুপ্রেরণা দেয়—“আমরা সবাই তারাধূলি দিয়ে তৈরি।”

একজন পেশাদার জ্যোতির্বিজ্ঞানী হিসেবে তাঁর গবেষণা ছিল মূলত গ্রহবিজ্ঞান নিয়ে। তিনি শুক্র, বৃহস্পতি এবং অন্যান্য গ্রহের বায়ুমণ্ডল নিয়ে গভীরভাবে কাজ করেছেন। বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য তাঁর সেই ভবিষ্যদ্বাণী, যেখানে তিনি শুক্র গ্রহের চরম তাপমাত্রা সম্পর্কে পূর্বাভাস দিয়েছিলেন—যা পরবর্তীতে বৈজ্ঞানিকভাবে সত্য প্রমাণিত হয়। একই সঙ্গে মঙ্গল গ্রহে প্রাণের সম্ভাবনা ও পরিবেশ নিয়ে তাঁর কাজ জ্যোতির্বিজ্ঞানে নতুন দিগন্ত উন্মোচন করে। তিনি নাসার বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ মহাকাশ মিশন—যেমন মেরিনার ও ভয়েজার প্রকল্পে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেন।

মঙ্গলের রহস্যময় “ক্যানালি” নিয়ে যখন পৃথিবীব্যাপী বিতর্ক চলছিল, তখন তিনি বৈজ্ঞানিক যুক্তি ও প্রমাণ দিয়ে ব্যাখ্যা করেন যে, এসব গঠন কোনো ভিনগ্রহবাসীর তৈরি নয়; বরং এগুলো প্রাকৃতিক ভূতাত্ত্বিক বৈশিষ্ট্য। তাঁর এমন বিশ্লেষণ গ্রহবিজ্ঞানের দৃষ্টিভঙ্গিতে নতুন দিগন্ত খুলে দেয়।

মানবজাতির অস্তিত্বকে মহাকাশের অজানা প্রাণীদের কাছে জানান দেওয়ার ধারণাতেও তিনি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। ১৯৭২ সালে উৎক্ষেপিত পাইওনিয়ার ১০ মহাকাশযানে মানুষের ছবি, সৌরজগতের অবস্থান এবং উৎক্ষেপণের সময়কাল সংবলিত একটি বিশেষ ফলক সংযুক্ত করা হয়েছিল—যার মূল পরিকল্পনাকারী ছিলেন তিনিই। পরবর্তীতে ১৯৭৭ সালে উৎক্ষেপিত ভয়েজার ১ ও ভয়েজার ২ মহাকাশযানের সোনালি ডিস্কে পৃথিবীর ছবি, সঙ্গীত, প্রাকৃতিক শব্দ ও বিভিন্ন ভাষার শুভেচ্ছাবার্তা পাঠানোর প্রকল্পেও তিনি নেতৃত্ব দেন। এই গোল্ডেন রেকর্ড আজও মহাশূন্যে পৃথিবীর প্রতিনিধি হিসেবে ভাসছে।

তাঁর অন্যতম বিখ্যাত উদ্যোগ ছিল ভয়েজার ১ মহাকাশযান থেকে পৃথিবীর একটি ছবি তোলার প্রস্তাব দেওয়া। ৬০০ কোটি কিলোমিটার দূর থেকে তোলা সেই ছবিতে পৃথিবীকে দেখা যায় এক ফ্যাকাশে নীল বিন্দুর মতো। সেই ছবিই পরবর্তীতে ইতিহাসে স্থান পায় “পেল ব্লু ডট” নামে। তাঁর চিন্তাধারায় এই ছবির বর্ণনা মানব সভ্যতার প্রতি এক অনন্য দৃষ্টিভঙ্গি তৈরি করে। তিনি লিখেছিলেন—
“এই ক্ষুদ্র বিন্দুর ওপরই বাস করছে আমাদের পরিচিত প্রত্যেক মানুষ। আমাদের হাসি, কান্না, ভালোবাসা, যুদ্ধ, বিশ্বাস, সভ্যতার উত্থান ও পতন—সবকিছু এই নীল বিন্দুর ওপরেই ঘটছে।”

১৯৯৬ সালে তিনি পৃথিবী ছেড়ে চলে গেলেও তাঁর চিন্তা, বক্তব্য ও কাজ আজও মানবজাতিকে অনুপ্রাণিত করে যাচ্ছে। তাঁর শিক্ষা শুধু মহাবিশ্বের দিকে তাকাতে নয়, বরং নিজেদের অস্তিত্বকেও নতুন করে বুঝতে শেখায়। পৃথিবীকে ‘নীল বিন্দু’ হিসেবে দেখার সেই ভাবনা আজও আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয়—এই বিশাল মহাবিশ্বে আমাদের জায়গা কত ক্ষুদ্র, কিন্তু কত মহামূল্যবান।

RELATED ARTICLES

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

- Advertisment -
Google search engine

Most Popular

Recent Comments