২০১৯ সালের নভেম্বর মাসে ভেনিস ইতিহাসের দ্বিতীয় ভয়াবহতম প্লাবনের সম্মুখীন হয়েছিল। পূর্ণিমার জোয়ার, প্রবল হাওয়া আর আকস্মিক ঘূর্ণিঝড় একত্রিত হয়ে শহরটিকে প্রায় ডুবিয়ে দেয়। সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বেড়ে দাঁড়ায় ১.৮৯ মিটার, যার ফলে শহরের প্রায় ৮৫% অংশ পানির নিচে তলিয়ে যায়। এই বিপর্যয় ভেনিসের টিকে থাকার প্রশ্নকে আবারও সামনে নিয়ে আসে, যেমনটা ঘটেছিল ১৯৬৬ সালের বিধ্বংসী “আক্কুয়া গ্রান্ডা”-এর সময়।
এই প্লাবনের মধ্যেই জন্ম নেয় এক ভিন্ন গল্প—সংগ্রহ করা বইয়ের গল্প, যা আজ শহরের সাংস্কৃতিক ভঙ্গুরতা এবং প্রতিরোধের প্রতীক হয়ে আছে।
একজন আলোকচিত্রী সেই ভয়াবহ রাতে খবর পেয়ে দ্রুত ভেনিসে পৌঁছান। তিনি দেখেন, রাস্তায় হাঁটুসমান পানি, ভাসমান আসবাবপত্র আর ভেজা ঘরের ভেতরে ছড়িয়ে থাকা জিনিসপত্র। তবুও তার নজর আটকে যায় বইয়ের দিকে। অনেকগুলো বই একেবারেই নষ্ট হয়ে গিয়েছিল, পাতাগুলো জমাট বেঁধে পাথরের মতো শক্ত হয়ে গিয়েছিল। তার চোখে এগুলো হয়ে ওঠে সময়ের প্রত্নসম্পদ, যেগুলো আর খোলা সম্ভব নয়, তবুও যেন অমূল্য এক প্রতীক।
সেখানেই থেমে থাকেননি তিনি। শহরের এক খ্যাতনামা বই বিক্রেতার দোকানে যান, যেখানে কর্মীরা দিনরাত এক করে চেষ্টা করছিলেন বই বাঁচানোর। অনেকগুলো পুরনো বই, বিশেষ করে ১৯০০ সালের শুরুর দিকের সংস্করণ, আর বাঁচানোর মতো ছিল না। দোকান কর্তৃপক্ষ সেসব নষ্ট বই তার হাতে তুলে দেন। এগুলোর ভেতর ছিল লাল কাপড়ে মোড়া এক কাব্য সংকলন, যা এখন ক্ষতবিক্ষত হয়ে আছে—যেন এক আহত বই।
মোট ৪০টি বই তিনি সংগ্রহ করেন। ভেজা, ছেঁড়া, স্পর্শ করলেই গুঁড়ো হয়ে যাওয়া বইগুলোকে তিনি বড় কালো ব্যাগে ভরে ফিরিয়ে আনেন। বই বহন করা ছিল কষ্টকর, তবুও এক গন্ডোলিয়েরের সহায়তায় তিনি সেগুলো নিরাপদে নিয়ে আসেন। পরে নিজ স্টুডিওতে প্রাকৃতিক আলোয় বইগুলোকে তিনি ছবিতে বন্দি করেন। বই না খুলেই তিনি সেগুলোকে যেভাবে পেয়েছিলেন, সেভাবেই তুলে ধরেন।
তার ছবিগুলোর ভেতর ছিল ১৯৪৯ সালের এক বিশ্বকোষ, যেখানে একটি প্রতীকী চিত্র দেখা যায়—যা রোমের প্রাচীন গুহা থেকে আগত এক রক্ষাকর্তার প্রতিমূর্তি। এটি তাকে আশ্বাস দেয়, ধ্বংসের মাঝেও আছে সুরক্ষা। অন্য এক বিশ্বকোষের আকৃতি তাকে মনে করিয়ে দেয় সমুদ্রের ঢেউয়ের কথা—যেন বই আর সমুদ্র এক হয়ে গেছে।
২০১৯ সালের এমন বিপর্যয় এখন আর বিরল নয়। সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা প্রতি বছর বাড়ছে, একই সঙ্গে ভেনিস ধীরে ধীরে ডুবে যাচ্ছে। ফলে প্লাবন এখন শহরের জীবনের অংশ হয়ে গেছে। স্থানীয় প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা “মোজে” থাকলেও শঙ্কা রয়েই গেছে।
আলোকচিত্রী বিশ্বাস করেন, ফটোগ্রাফি কেবল নথিভুক্ত করে না, বরং তা নতুন চিন্তা জাগায়, প্রতিরোধের প্রতীক হয়ে ওঠে। ধ্বংসের ভেতরে আশা খুঁজে পাওয়া, হারানো সংস্কৃতির মাঝে প্রতিরোধের বার্তা ছড়িয়ে দেওয়া—এই বইগুলো তার কাছে ঠিক সেই গল্পই বলে।
আজ এই ভেজা, ক্ষয়ে যাওয়া বইগুলো ভেনিসের জন্য এক প্রতীক—সংস্কৃতির ভঙ্গুরতা, কিন্তু একইসঙ্গে লড়াই আর টিকে থাকার শক্তির প্রতিচ্ছবি।