Thursday, November 20, 2025
spot_img
Homeইমিগ্রেশন তথ্যভয়, নীরবতা ও অন্যায়ের ঘেরাটোপে অভিবাসীদের আদালত: ন্যায়ের জায়গা যেন হয়ে উঠেছে...

ভয়, নীরবতা ও অন্যায়ের ঘেরাটোপে অভিবাসীদের আদালত: ন্যায়ের জায়গা যেন হয়ে উঠেছে আতঙ্কের প্রাঙ্গণ

নিউইয়র্কের ফেডারেল ভবনের অভ্যন্তরে অভিবাসন আদালতের করিডোর এখন এক ভয়ের নাম। নাগরিকত্বের বৈধ প্রক্রিয়ায় অংশ নিতে আসা মানুষগুলো সেখানে মুখোমুখি হচ্ছে মুখোশ পরা সশস্ত্র কর্মকর্তাদের—যারা মুহূর্তের মধ্যেই কাউকে ‘অদৃশ্য’ করে দিতে পারে। আদালতের অপেক্ষা কক্ষগুলোতে সবাই নিচু গলায় কথা বলে, যেন শব্দের মধ্যেও ভীতি ছড়িয়ে আছে।

ভবনের ১২ ও ১৪ তলায় অবস্থিত আদালতগুলো এক সময় ছিল আশার জায়গা—যেখানে কেউ নাগরিকত্বের স্বপ্ন পূরণ করত, কেউ পরিবার ফিরে পেত, কেউ আশ্রয় প্রার্থনা করত। কিন্তু এখন সেই জায়গাটাই পরিণত হয়েছে ভয়ংকর এক ফাঁদে। আদালতের দরজা পেরোলেই দেখা যায়, ভারী জ্যাকেট, বুলেটপ্রুফ জ্যাকেট, ও মুখ ঢেকে রাখা একদল কর্মকর্তা দাঁড়িয়ে আছেন, যেন আইন প্রয়োগ নয়, শিকার ধরার অপেক্ষায়।

এরা যুক্তরাষ্ট্রের নিরাপত্তা সংস্থার অংশ হলেও, আদালতের নিরাপত্তার দায়িত্ব তাদের নয়। তবু তারা ভবনের যেকোনো তলায় অবাধে চলাফেরা করে। এক কর্মকর্তা এক তরুণী অভিবাসীর মুখ থেকে মাস্ক খুলে ফোনে ছবি তুলে চলে যায়—কোনো ব্যাখ্যা ছাড়াই। কেউ কিছু বলতে পারে না। এই ভবনের নিয়ম যেন একটাই: এখানে এই কর্মকর্তারা যা খুশি তাই করতে পারে।

একজন স্বেচ্ছাসেবক, যিনি প্রায়ই আদালতে যান অভিবাসীদের সহায়তা করতে, বলেন—“আমরা শুধু পাশে থাকি, কিছু বুঝিয়ে দেই। কিন্তু যখন কাউকে ধরে নিয়ে যায়, আমরা কিছুই করতে পারি না।” তার মতে, এই পুরো প্রক্রিয়াই এক ধরনের নিষ্ঠুরতা, যেখানে আইনি প্রক্রিয়ায় থাকা মানুষগুলোকেও অপরাধীর মতো আচরণ করা হয়।

অভ্যন্তরের ১০ তলায় রয়েছে আটক কক্ষগুলো, যেগুলোতে মানুষকে কখনও তিন দিন পর্যন্ত রাখা হয়। শোনা যায়, সেসব জায়গায় শোয়ার বিছানা নেই, টয়লেটগুলো অপরিচ্ছন্ন, এবং মানুষগুলো ঠাসাঠাসি করে থাকে। আদালতে উপস্থিত প্রত্যক্ষদর্শীদের বর্ণনায় জানা গেছে, অনেক সময় বন্দিদের পশুর মতো অবস্থায় থাকতে দেখা যায়। এক ভিডিওতে একজন বলেন, “দেখুন আমাদের অবস্থা—এ যেন কুকুরের মতো জীবন।”

সবচেয়ে মর্মান্তিক বিষয় হলো, এই মানুষগুলো অধিকাংশই বৈধ কাগজপত্রসহ আদালতে আসে—কেউ আশ্রয়ের আবেদন নিয়ে, কেউ নাগরিকত্বের কাগজ হাতে। তারা “সঠিক উপায়ে” দেশটিতে থাকতে চায়। অথচ সেই বৈধ পথই এখন হয়ে উঠেছে তাদের জন্য মৃত্যুফাঁদ। আদালতের ভেতরে আইনের আশ্রয় নিতে আসা মানুষরা জানে না, বেরিয়ে আসার পর তারা স্বাধীন থাকবে, নাকি বন্দি হবে।

এক নারী আদালতে জেতার পরও বের হতে ভয় পাচ্ছিলেন, কারণ বাইরে মুখোশধারী কর্মকর্তারা দাঁড়িয়ে। শেষে এক যাজক তাকে সাহস জোগান, প্রায় টেনে নিয়ে যান দরজা পার করে। আবার এক আরবি ভাষাভাষী পুরুষকে এক স্বেচ্ছাসেবক সহায়তা করতে চাইলেও পারেননি—ভাষার কারণে যোগাযোগ হয়নি, আর কর্মকর্তারা তাকেও নিয়ে যায়।

এই কর্মকর্তারা যাদের গ্রেপ্তার করছে, তাদের অনেক সময় ভুল করেও ধরে ফেলে। আদালতের নথি, ছবির মিল না থাকলেও ভুল ব্যক্তিকে আটকে ফেলা নতুন কিছু নয়। একদিন পুরো তলজুড়ে সাংবাদিক, নিরাপত্তাকর্মী ও কর্মকর্তাদের আনাগোনায় পরিবেশ হয়ে ওঠে তীব্র টানটান। একজন সাংবাদিক বলেন, “এ যেন DMV অফিসের মতো—কিন্তু এখানে ভয় মিশে আছে।”

প্রায়শই দেখা যায়, আদালত শেষ হওয়ার পরই কর্মকর্তারা ঝাঁপিয়ে পড়ে কাউকে নিয়ে যাচ্ছে। কখনও কখনও এমনও হয়—যার মামলা অনুমোদিত, তাকেও ধরা হয় ভুলবশত। কিছুদিন আগেই এক কর্মকর্তা এক নারীকে মাটিতে ফেলে দেয়, ভিডিও ছড়িয়ে পড়লে সাময়িকভাবে তাকে দায়িত্ব থেকে সরানো হয়, তবে সপ্তাহ না যেতেই সে আবার ফিরে আসে কাজে।

এই পুরো প্রক্রিয়া যেন “ন্যায়বিচার” নয়, বরং এক ধরনের রাষ্ট্রীয় ভয় প্রদর্শনের কৌশল। আদালত, যা একসময় ছিল আশ্রয়ের জায়গা, আজ হয়ে উঠেছে এক অনিশ্চিত দুঃস্বপ্ন।
একজন পর্যবেক্ষকের ভাষায়, “এই মানুষগুলো ন্যায় খুঁজতে আসে, কিন্তু এখানে তারা পায় শুধু আতঙ্ক। আইন নয়, এখানে চলছে ভয় দেখানোর রাজনীতি।”

আজকের আমেরিকা যেন এই ভবনের করিডোরেই প্রতিফলিত—যেখানে আইনের ছায়ায় দাঁড়িয়ে আছে মুখোশধারী ভয়, এবং মানবিকতার জায়গা ক্রমেই সঙ্কুচিত হয়ে পড়ছে।

RELATED ARTICLES

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

- Advertisment -
Google search engine

Most Popular

Recent Comments