Thursday, November 20, 2025
spot_img
Homeসম্পাদকীয়ব্রিটেনে রাষ্ট্র পরিচালনার সংকট: বিনিয়োগ নয়, রক্ষণাবেক্ষণের ব্যর্থতাই মূল সমস্যা

ব্রিটেনে রাষ্ট্র পরিচালনার সংকট: বিনিয়োগ নয়, রক্ষণাবেক্ষণের ব্যর্থতাই মূল সমস্যা

ব্রিটেনে সাম্প্রতিক সময়ে একাধিক প্রশাসনিক ব্যর্থতা দেশটির রাষ্ট্রীয় কাঠামোর গভীর সমস্যাকে সামনে এনেছে। সম্প্রতি যৌন অপরাধের দায়ে দণ্ডপ্রাপ্ত এবং বহিষ্কারের অপেক্ষায় থাকা এক ব্যক্তির ভুলবশত মুক্তি পাওয়া ঘটনাটি কেবল একটি উদাহরণ। এটি পুরো ব্যবস্থার অদক্ষতা ও অব্যবস্থাপনার প্রতিফলন।

বছরের পর বছর সরকারি খাতে ব্যয় সংকোচন বা তথাকথিত “অস্টেরিটি” নীতির ফলে আজ ব্রিটিশ রাষ্ট্রের বহু গুরুত্বপূর্ণ সেবা ব্যবস্থা কার্যত ভেঙে পড়েছে। স্বাস্থ্য, কারাগার, স্থানীয় প্রশাসন—সব ক্ষেত্রেই দেখা যাচ্ছে অচলাবস্থা। দীর্ঘ সময় ধরে সরকার যে হারে ব্যয় বাড়িয়েছে, তা দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির তুলনায় অনেক কম। গত এক দশকে বার্ষিক সরকারি ব্যয় বৃদ্ধি ছিল মাত্র ১% এর কিছু বেশি, যেখানে দীর্ঘমেয়াদে এ হার গড়ে ২.৬%।

এই পরিসংখ্যানের পেছনে যে বাস্তবতা লুকিয়ে আছে তা হলো—সরকার বড় বড় প্রকল্পে অর্থ বিনিয়োগ করলেও, সেই অবকাঠামোর রক্ষণাবেক্ষণে যথেষ্ট গুরুত্ব দেয়নি। ফলে নতুন স্থাপনা তৈরি হলেও, সেগুলো কার্যকরভাবে চালিয়ে নেওয়ার সক্ষমতা ক্রমেই কমে যাচ্ছে।

অন্যদিকে, কারাগার ব্যবস্থার অবস্থা ভয়াবহ। বাজেট কমে যাওয়ার পাশাপাশি কর্মী সংকট মারাত্মক আকার ধারণ করেছে। গত এক দশকে কারাগার বিভাগে প্রায় ৩০% কর্মী হারিয়েছে, ফলে নতুন ও অনভিজ্ঞ কর্মকর্তাদের ওপর অতিরিক্ত চাপ পড়েছে। এর ফলেই ভুলবশত বন্দি মুক্তি পাওয়ার ঘটনা বেড়েছে। সাম্প্রতিক পরিসংখ্যান অনুযায়ী, গত বছর ২৬২ জন বন্দি ভুলবশত মুক্তি পেয়েছেন—যা ২০২৩ সালের তুলনায় দ্বিগুণ এবং ২০১৪ সালের তুলনায় চারগুণ বেশি।

বর্তমান প্রশাসন কারাগারের সক্ষমতা বাড়াতে নতুন ১৪,০০০ স্থানের পরিকল্পনা করেছে। তবে বিশেষজ্ঞদের মতে, শুধুমাত্র নতুন ভবন তৈরি করলেই সমস্যার সমাধান হবে না; পর্যাপ্ত প্রশিক্ষিত কর্মী না থাকলে এই উদ্যোগও ব্যর্থ হবে।

অর্থনৈতিক নীতিনির্ধারক প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যেও পরিবর্তনের আভাস দেখা যাচ্ছে। দীর্ঘদিন ধরে রাষ্ট্রীয় বিনিয়োগকে অপচয় হিসেবে দেখা হলেও, সাম্প্রতিক মূল্যায়নে প্রথমবারের মতো স্বীকার করা হয়েছে—জনগণের কল্যাণে বিনিয়োগ অর্থনীতিকে ইতিবাচকভাবে প্রভাবিত করতে পারে। গত বছর প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বলা হয়, সরকারি বিনিয়োগের সঠিক ব্যবস্থাপনা রাষ্ট্রীয় উৎপাদনশীলতা বাড়াতে সহায়ক হতে পারে।

অর্থনীতিবিদরা মনে করেন, ব্রিটেনের উৎপাদনশীলতা দীর্ঘদিন ধরে স্থবির হয়ে আছে। ২০০৮ সালের বৈশ্বিক আর্থিক সংকটের পর থেকে বেসরকারি ও সরকারি খাতের বিনিয়োগ কমে গেছে। অনিশ্চয়তা এবং ব্যয় সংকোচনের নীতির কারণে নতুন প্রকল্পে উদ্যোক্তারা আগ্রহ হারাচ্ছেন। ফলে দেশটি ক্রমে নিম্ন উৎপাদনশীলতার ফাঁদে আটকে পড়ছে।

এ পরিস্থিতিতে নীতিনির্ধারকদের দায়িত্ব হলো বাস্তবতাকে স্বীকার করা—রাষ্ট্রীয় ব্যয় মানেই অপচয় নয়। বরং সময়মতো রক্ষণাবেক্ষণ ও দক্ষ ব্যবস্থাপনা ছাড়া কোনো অবকাঠামোই দীর্ঘমেয়াদে কার্যকর থাকে না। কারাগার, হাসপাতাল কিংবা স্থানীয় প্রশাসন—সব ক্ষেত্রেই দক্ষ জনবল ও টেকসই বিনিয়োগই হতে পারে সমাধান।

অর্থনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, যদি সঠিকভাবে রাষ্ট্রীয় ব্যয়ের প্রভাব পরিমাপ করা হয়, তাহলে দেখা যাবে আসল “গ্যাপ” কেবল অর্থনীতিতে নয়, বরং সমাজের কার্যকারিতায় সৃষ্টি হয়েছে। যখন কারাগার কর্তৃপক্ষই জানে না কারা বন্দি থাকার কথা, তখন সমস্যা শুধু ব্যবস্থাপনায় নয়—রাষ্ট্রের কাঠামোগত দুর্বলতায়।

RELATED ARTICLES

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

- Advertisment -
Google search engine

Most Popular

Recent Comments