২০২০ সালের জানুয়ারিতে মাত্র ১২ ঘণ্টার লেওভারেই কলম্বিয়ার রাজধানী বোগোটার প্রেমে পড়ে গিয়েছিলাম। এল দোরাডো আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে নেমে দিনটা অপচয় না করে স্থানীয় বন্ধুর সঙ্গে শহর ঘুরতে বেরিয়েছিলাম। কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই বুঝেছিলাম—এই শহর আলাদা। এরপর থেকে দশ বারেরও বেশি বোগোটা গিয়েছি, এমনকি ২০২২ সালে সেখানে পাঁচ মাস থেকেছি।
লাতিন আমেরিকার পর্যটন মানচিত্রে মেডেলিন বা কার্তাহেনা যতটা আলো পায়, বোগোটা যেন সেই তুলনায় অনেকটাই আড়ালে থাকে। অথচ এই শহরেই আছে বিশ্বমানের জাদুঘর, মনোমুগ্ধকর পাহাড়ঘেরা দৃশ্য, এবং পুরো মহাদেশের অন্যতম সেরা ফাইন ডাইনিং সংস্কৃতি।
নিরাপত্তা ও স্থানীয় সংস্কৃতি
বোগোটা ভ্রমণে সবচেয়ে সাধারণ প্রশ্ন হলো—‘ওখানে নিরাপদ কি?’
গত শতাব্দীর শেষের দিকের রাজনৈতিক অস্থিরতা অনেক আগেই ইতিহাসে পরিণত হয়েছে। এখন শহর অনেক উন্নত, যদিও পর্যটকদের সবসময় সতর্ক থাকা প্রয়োজন। স্থানীয়রা বলে, “No des papaya”—অর্থাৎ “নিজেকে লক্ষ্য বানিও না।” ঝলমলে গয়না পরা, নির্জন রাস্তায় হাঁটা বা মোবাইল হাতে নিয়ে ঘোরাঘুরি করা বিপজ্জনক হতে পারে। নিরাপদ ভ্রমণের জন্য স্থানীয় ট্যাক্সির বদলে রাইডশেয়ার অ্যাপ ব্যবহার করাই উত্তম।
কলম্বিয়ার সরকারি ভাষা স্প্যানিশ, তাই বোগোটায় ভ্রমণের আগে অল্প কিছু মৌলিক শব্দ শেখা ভালো। যদিও তরুণ প্রজন্ম ইংরেজি জানে, তবুও রেস্টুরেন্ট বা বাজারে ইংরেজি-বিমুখ মানুষ পাওয়া স্বাভাবিক। স্থানীয়দের সঙ্গে একটু স্প্যানিশে কথা বলার চেষ্টা করলে তারা খুবই সহানুভূতিশীল হয়।
এখানকার মুদ্রা হলো কলম্বিয়ান পেসো। ডিসেম্বর থেকে মার্চ পর্যন্ত সময়টা তুলনামূলক শুষ্ক, তাই ভ্রমণের জন্য উপযুক্ত। মার্কিন নাগরিকদের ভিসা ছাড়াই ৯০ দিন পর্যন্ত থাকার অনুমতি মেলে। তবে মনে রাখতে হবে—বোগোটা সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ৮,৬৬০ ফুট উঁচুতে অবস্থিত, ফলে অনেকেরই হালকা উচ্চতাজনিত অসুস্থতা হতে পারে।
দেখার জায়গা
৬১৩ বর্গমাইল আয়তনের শহর হলেও পর্যটকরা মূলত কয়েকটি নির্দিষ্ট এলাকাতেই বেশি সময় কাটান।
ঐতিহাসিক লা কানডেলারিয়া অঞ্চলের রঙিন স্থাপত্য ও পাথরের রাস্তা মন ছুঁয়ে যায়। এখানেই আছে বিখ্যাত প্লাজা দে বোলিভার। তবে সূর্যাস্তের আগে এলাকা ছেড়ে যাওয়াই বুদ্ধিমানের কাজ। আধুনিক শহুরে সৌন্দর্য দেখতে চাইলে সান্তা ফে ও চাপিনেরো এলাকায় যেতে পারেন—আকাশচুম্বী ভবন আর চমৎকার রেস্টুরেন্টে ভরপুর এই অংশগুলো।
শিল্পপ্রেমীদের জন্য বোগোটা যেন এক খোলা জাদুঘর। মুসেও দেল ওরো বা গোল্ড মিউজিয়ামে দেখা মেলে কলম্বিয়ার আদিবাসী শিল্পের অমূল্য নিদর্শন। একটু দক্ষিণে বতেরো মিউজিয়াম আছে, যা দেশের অন্যতম খ্যাতনামা শিল্পীর প্রতি উৎসর্গীকৃত। আর উত্তর দিকে ন্যাশনাল মিউজিয়াম অফ কলম্বিয়া—যেখানে আছে প্রাচীন প্রত্নবস্তু থেকে আধুনিক চিত্রকলার বিশাল সংগ্রহ।
প্রকৃতিপ্রেমীদের জন্য আছে বোগোটা বোটানিক্যাল গার্ডেন, যা কলম্বিয়ার সবচেয়ে বড় উদ্ভিদ উদ্যান। আর শহরের সবচেয়ে জনপ্রিয় দর্শনীয় স্থান মোনসেরাতে পাহাড়—১০,৩৪১ ফুট উচ্চতার এই স্থান থেকে পুরো শহরের দৃশ্য দেখা যায়, সঙ্গে রয়েছে ১৭ শতকের গির্জা ও স্মারক দোকান।
খাবার ও রেস্টুরেন্ট
বোগোটার ঠান্ডা আবহাওয়ায় গরম, পুষ্টিকর খাবার যেন স্বর্গীয় অনুভূতি দেয়। এখানকার ঐতিহ্যবাহী খাবার আজিয়াকো—এক ধরনের ঘন স্যুপ, যাতে থাকে আলু, ভুট্টা, কেপার ও স্থানীয় গুয়াসকা হার্ব। এই খাবার শহরের প্রায় সব জায়গায় পাওয়া যায়, তবে পুরোনো শহরের কিছু ঐতিহ্যবাহী রেস্টুরেন্টে এর স্বাদ অতুলনীয়।
তাছাড়া স্থানীয় পদ আরেপাস (ভুট্টার পিঠা) ও কালদো দে কস্তিয়া (গরুর মাংসের স্যুপ) জনপ্রিয়। স্ন্যাক্স হিসেবে বুয়ুয়েলোস ও পান দে বোনো চেখে দেখতে ভুলবেন না।
উচ্চমানের খাবারের স্বাদ নিতে চাইলে চলে যেতে পারেন জোনা জি এলাকায়—এখানে আছে বিলাসবহুল রেস্টুরেন্ট, বিশ্বমানের হোটেল ও আধুনিক কফি বারের সমাহার। অন্যদিকে জোনা টি রাতের বিনোদনের জন্য বিখ্যাত; লাইভ মিউজিক, পাব ও ক্র্যাফট বিয়ারের জায়গা হিসেবে এটি সবার প্রিয়। আর খাবারপ্রেমীদের জন্য পার্কে ৯৩ এক স্বর্গ, যেখানে রয়েছে আন্তর্জাতিক মানের রেস্টুরেন্ট ও ফিউশন কুইজিন।
বোগোটার সবচেয়ে বড় আকর্ষণ এর খাদ্য বৈচিত্র্য। লাতিন আমেরিকান খাবার ছাড়াও এখানে পাওয়া যায় ভারতীয়, ইউরোপীয় কিংবা আমেরিকান স্বাদ। প্রতিটি রেস্টুরেন্ট যেন একেকটি সাংস্কৃতিক অভিজ্ঞতা, যা প্রমাণ করে—বোগোটা এক অনন্য শহর, যেখানে ঐতিহ্য ও আধুনিকতার মেলবন্ধন ঘটেছে নিখুঁতভাবে।



