বিশ্ববাজারে সোনার মূল্য টানা ঊর্ধ্বমুখী থাকলেও ক্রিপ্টো বাজারে গত কয়েক মাসে উল্টোপথে হাঁটা দেখা যাচ্ছে। বিশেষ করে বিটকয়েনসহ বিভিন্ন ডিজিটাল মুদ্রার দামে এমন পতন ঘটেছে যে অভিজ্ঞ বিনিয়োগকারীরাও বিস্মিত। এ খাতের অস্থিরতা নতুন নয়, তবে সাম্প্রতিক ছয় মাসের ধকল অভূতপূর্ব।
বিশ্লেষকের তথ্যে জানা যায়, এ সময়ে বিশ্বজুড়ে ক্রিপ্টো বাজারের মোট মূলধন কমে গেছে প্রায় এক ট্রিলিয়ন ডলার, যা এক লাখ কোটি ডলারের সমান। ফলে এ বাজারের অন্ধ সমর্থকেরাও দিশেহারা হয়ে পড়েছেন এবং নতুন বিনিয়োগকারীরা ভবিষ্যৎ নিয়ে অনিশ্চয়তায় ভুগছেন। আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যম সিএনএন জানিয়েছে, এই পতন বিনিয়োগকারীদের আত্মবিশ্বাসে বড় ধরনের আঘাত হেনেছে।
ক্রিপ্টো জগতে সবচেয়ে পরিচিত মুদ্রা হলো বিটকয়েন। জনপ্রিয়তার দিক থেকেও এটি অন্য সব মুদ্রাকে পেছনে ফেলে রেখেছে। অথচ অক্টোবরের শুরু থেকে এ মুদ্রার দাম দ্রুত নেমে এসেছে। মাসের শুরুতে যেখানে এক বিটকয়েনের মূল্য ছিল ১ লাখ ২৬ হাজার ডলার, সেখানে গত শুক্রবার তা নেমে আসে ৮১ হাজার ডলারে। সোমবার বাজার খোলার পর দাম কিছুটা বেড়ে ৮৮ হাজার ডলারে পৌঁছালেও সামগ্রিক প্রবণতা রয়ে গেছে নিম্নমুখী।
গোল্ড প্রাইস ডট অর্গের তথ্য অনুযায়ী, গত এক মাসে সোনার দাম আউন্সপ্রতি বেড়েছে ৯০ ডলার এবং ছয় মাসে বাড়তি যোগ হয়েছে আরও ৭৫৪ ডলার ৪৫ সেন্ট। অর্থাৎ পুঁজি নিরাপদ সম্পদের দিকে সরে যাচ্ছে।
নভেম্বরকে এখন ক্রিপ্টো বাজারের ইতিহাসে অন্যতম খারাপ মাস হিসেবে দেখা হচ্ছে। এ ধস কতটা স্থায়ী হতে পারে, তা এখনও অনিশ্চিত। জার্মানির ডয়েচে ব্যাংকের বিশ্লেষকেরা জানিয়েছেন, আগামী মাসে বাজার সংশোধন হবে কি না, তারও কোনও নিশ্চয়তা নেই। এর আগে মূলত ব্যক্তিপর্যায়ের বিনিয়োগকারীরাই এ বাজারে সক্রিয় থাকলেও ধীরে ধীরে যুক্তরাষ্ট্রে প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীদের অংশগ্রহণ বাড়ছে। লেনদেন সহজ হয়েছে এবং নীতিগত সুবিধাও দেওয়া হয়েছে, তবুও পতন থামছে না।
বাজার বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ক্রিপ্টো বাজারে প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগের উপস্থিতি বৃদ্ধির ফলে আগের মতো আচরণ দেখা যাচ্ছে না। আগে এই খাত শেয়ারবাজারের মতো ওঠানামা করলেও এখন এর পতনের পেছনের কারণ আরও গভীর। প্রচলিত শেয়ারবাজারের সূচক এসঅ্যান্ডপির সাম্প্রতিক সর্বোচ্চ অবস্থান থেকে পতন মাত্র ৩ শতাংশ হলেও বিটকয়েনের পতন হয়েছে প্রায় ৩০ শতাংশ। ২০২২ সালে এক বড় ধরনের কেলেঙ্কারি ফাঁস হওয়ার পর যে অস্থিরতা দেখা দিয়েছিল, চলতি নভেম্বর তেমনই আরেকটি কঠিন সময় তৈরি করেছে।
বাজার নিয়ে আরও দুটি বড় উদ্বেগ দেখা দিয়েছে বিনিয়োগকারীদের মধ্যে। প্রথমত, যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল রিজার্ভ কবে নীতি সুদহার কমাবে তা স্পষ্ট নয়। দ্বিতীয়ত, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাকে ঘিরে যে বিনিয়োগের বুদ্বুদের সৃষ্টি হয়েছে, তা কতটা স্থায়ী হবে তা নিয়েও প্রশ্ন রয়েছে। সুদহার বেশি থাকলে বিনিয়োগ খরচ বাড়ে, ফলে ঝুঁকিপূর্ণ সম্পদে আগ্রহ কমে।
অক্টোবরের মাঝামাঝি হঠাৎ বাজার ধস নামলে ক্রিপ্টো খাত আরও বিপাকে পড়ে। যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্টের বাণিজ্যনীতি নিয়ে নতুন করে উত্তেজনা তৈরি হওয়ায় আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে এবং বিনিয়োগকারীরা ব্যাপকভাবে সম্পদ বিক্রি শুরু করেন। একদিনেই প্রায় ১৯ বিলিয়ন ডলার বাজারমূলধন উধাও হয়ে যায়। এতে অনেকেই ক্রিপ্টো বাজার থেকে সম্পূর্ণ বেরিয়ে যাওয়ার কথা ভাবতে শুরু করেন।
এ ধসে আরও একটি নতুন উপাদান যুক্ত হয়েছে। গত বছর যুক্তরাষ্ট্রে অনুমোদিত স্পট বিটকয়েন তহবিল বাজারে বিপুল পরিমাণ নতুন পুঁজি এনেছে। কিন্তু মূলধারার বিনিয়োগকারীরা দাম কমলে আগের অনুসারীদের মতো আরও ক্রিপ্টো কিনে আগ্রহ দেখাচ্ছেন না। ফলে বাজারে শৃঙ্খল প্রতিক্রিয়া তৈরি হয়েছে এবং দামের পতন আরও দ্রুততর হয়েছে।
ইন্টারঅ্যাকটিভ ব্রোকার্সের প্রধান কৌশলবিদ জানিয়েছেন, এখন বিটকয়েনের বড় অংশই সাধারণ বিনিয়োগকারীদের হাতে। তাই অনেকেই এটিকে আরেকটি ঝুঁকিপূর্ণ সম্পদ হিসেবে বিবেচনা করছেন।
বাজারে অনিশ্চয়তা বাড়লে সাধারণত বিনিয়োগকারীরা ঝুঁকি এড়িয়ে সোনার মতো নিরাপদ সম্পদের দিকে ঝুঁকে পড়েন। ফলে ক্রিপ্টোর দাম পড়ে যায় এবং সোনার মূল্য বাড়ে। তবে যখন বাজার স্থিতিশীল থাকে, তখন আবার ক্রিপ্টোর প্রতি আগ্রহ বাড়ে এবং সোনা কিছুটা পিছিয়ে পড়ে। উচ্চমূল্যস্ফীতির সময়ে দুটিই বাড়তে পারে, কারণ কেউ সোনায়, কেউ ডিজিটাল সোনা হিসেবে বিটকয়েনে বিনিয়োগ করেন।



