বাংলাদেশ টেস্ট ক্রিকেটে পা রাখার ২৫ বছর পূর্ণ করেছে। এক সময় স্বপ্ন ছিল সেরাদের কাতারে জায়গা করে নেওয়ার, কিন্তু রজতজয়ন্তী বছরে এসে দেখা যাচ্ছে, সেই স্বপ্ন এখনো অপূর্ণ। দেশের সাবেক অধিনায়কেরা ফিরে দেখছেন অতীত, বলছেন বর্তমানের সীমাবদ্ধতার কথা আর ভাবছেন আগামী দিনের সম্ভাবনা নিয়ে।
জাতীয় দলের সাবেক অধিনায়ক আকরাম খানের মতে, বাংলাদেশের টেস্ট যাত্রা শুরু হয়েছিল এক বিশাল আশাবাদ নিয়ে—সেরা চার দলের মধ্যে জায়গা পাওয়ার স্বপ্নে। কিন্তু এত বছরেও সেই লক্ষ্য পূরণ হয়নি। টেস্ট মর্যাদা পাওয়ার সময় দেশের নিজস্ব আন্তর্জাতিক মানের মাঠ ছিল না, অনুশীলনের সুযোগও ছিল সীমিত। এখন মাঠ বেড়েছে, সুযোগ-সুবিধাও অনেক উন্নত, খেলোয়াড়রা আর্থিকভাবে স্বচ্ছল। তবুও পারফরম্যান্সে বাংলাদেশ বিশ্বমঞ্চে নিজেদের জায়গা মজবুত করতে পারেনি।
আকরাম বলেন, “এখনকার খেলোয়াড়রা অনেক সুযোগ-সুবিধা পাচ্ছে। কিন্তু তাদের মধ্যে বড় কিছু করার মানসিকতা কম। তারা অল্পতেই সন্তুষ্ট হয়ে যায়, আবার অল্পতেই মন ভেঙে যায়।” তাঁর মতে, ১০–১৫ বছর আগে যখন অবকাঠামো এত উন্নত ছিল না, তখনও সাকিব আল হাসানের মতো বিশ্বমানের খেলোয়াড় উঠে এসেছিল। কিন্তু এখন সুযোগ বাড়লেও প্রতিভা সেই হারে গড়ে উঠছে না।
জাতীয় দলের আরেক সাবেক অধিনায়ক খালেদ মাসুদ মনে করেন, টেস্ট ক্রিকেটে বাংলাদেশের উন্নতি প্রত্যাশিত গতিতে হয়নি মূলত পরিকল্পনা আর নেতৃত্বের ঘাটতির কারণে। তাঁর মতে, বাংলাদেশের ক্রিকেটের জনপ্রিয়তা অনেক, কিন্তু সেটাকে কাজে লাগানো যায়নি। টেস্ট ক্রিকেটে চারটি প্রজন্ম চলে গেছে, কিন্তু প্রত্যেক প্রজন্ম আগের প্রজন্মকে ছাড়িয়ে যেতে পারেনি।
খালেদ বলেন, “বাংলাদেশে এমন এক ক্রিকেট সংস্কৃতি তৈরি হয়েছে, যেখানে চাইলেও কেউ বিরাট কোহলি হতে পারবে না। যেমন কেউ যদি চীনে গিয়ে ব্রায়ান লারা হতে চায়, সেটা সম্ভব নয়, কারণ ওই সংস্কৃতি নেই। একইভাবে এখানে ক্রিকেটাররা বড় হতে চাইলেও সঠিক সিস্টেম ও পরিকল্পনার অভাবে সেটা সম্ভব হচ্ছে না।”
তিনি আরও বলেন, “আমাদের অবকাঠামো উন্নত হয়নি, সুযোগ-সুবিধা যথেষ্ট নয়। মিরপুরই আমাদের সব। অথচ ভারতের রায়পুরের মতো শহরেও এমন সব সুযোগ আছে, যেখানে আইপিএল হয় না। পরিকল্পনা আর যোগ্য নেতৃত্বের অভাবেই আমরা পিছিয়ে আছি।”
অন্যদিকে জাতীয় দলের সাবেক অধিনায়ক হাবিবুল বাশারের মতে, বাংলাদেশের ব্যাটসম্যানদের সবচেয়ে বড় দুর্বলতা হলো ধারাবাহিকতা ও দীর্ঘ ইনিংস খেলার মানসিকতা না থাকা। তাঁর ভাষায়, “আমরা টেস্ট ক্রিকেটে এখনো নিজেদের জায়গা তৈরি করতে পারিনি। বড় ইনিংস খেলতে হলে মানসিকভাবে ফিট থাকা দরকার। কিন্তু আমাদের ব্যাটসম্যানরা ঘরোয়া ক্রিকেটে ধারাবাহিকভাবে খেলে না।”
তিনি আরও বলেন, “সাদা বলে খেলা সহজ, আর্থিক দিক থেকেও লাভজনক। তাই সবাই সাদা বলে ঝুঁকে পড়ছে। কিন্তু কোচদের দায়িত্ব খেলোয়াড়দের বুঝিয়ে দেওয়া—সাদা বল নয়, টেস্ট বা লাল বলের ক্রিকেটেই প্রকৃত উন্নতি সম্ভব।”
হাবিবুলের মতে, বড় ইনিংস খেলতে গেলে ধৈর্য, মানসিক শক্তি আর পরিশ্রম প্রয়োজন। সহজ সময় আসে, আবার কঠিন সময়ও আসে। সেই সময়গুলো অতিক্রম করেই একজন ব্যাটসম্যান বড় হয়। কিন্তু বাংলাদেশের খেলোয়াড়রা এক শ রান করেই সন্তুষ্ট হয়ে যায়, যা আন্তর্জাতিক মানের ক্রিকেটে যথেষ্ট নয়।
২৫ বছরের যাত্রায় বাংলাদেশের টেস্ট ক্রিকেট অনেক দূর এগোলেও এখনো কাঙ্ক্ষিত উচ্চতায় পৌঁছায়নি। অবকাঠামো, পরিকল্পনা, নেতৃত্ব এবং ক্রিকেট সংস্কৃতির ঘাটতি পূরণ না হলে ‘বিরাট কোহলি’ হওয়ার স্বপ্ন এখানেই থেমে থাকবে বলে মনে করছেন সাবেকরা।



