বাংলাদেশের প্রখ্যাত লোকগায়িকা, লালন গীতের রানি হিসেবে খ্যাত ফারিদা পারভীন, শনিবার রাত ১০:১৫ মিনিটে শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেছেন। তিনি ৭০ বছর বয়সে মৃত্যুবরণ করলেন। দীর্ঘদিন ধরে কিডনি জটিলতার সঙ্গে লড়াই করে আসছিলেন তিনি। সাম্প্রতিক মাসগুলোতে তার স্বাস্থ্য অবনতি হওয়ায় সপ্তাহে দুইবার ডায়ালিসিসের প্রয়োজন ছিল। ২ সেপ্টেম্বর নিয়মিত ডায়ালিসিসের পর অবস্থা গুরুতর হওয়ায় তাকে ইউনিভার্সাল মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। আইসিইউতে স্থানান্তরের পর শ্বাসপ্রশ্বাস সংকটে ভেন্টিলেশনে রাখা হয়। চিকিৎসার চেষ্টার পরও শনিবার রাতেই তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।
ফারিদা পারভীন তার স্বামী ও চার সন্তানকে রেখে গেছেন।
১৯৫৪ সালের ৩১ ডিসেম্বর নাটোরে জন্ম নেওয়া এবং কুষ্টিয়ায় বেড়ে ওঠা ফারিদা পারভীনের শৈশব থেকেই সংগীতের প্রতি গভীর আগ্রহ ছিল। পিতার উৎসাহে তিনি প্রথম কক্ষকলা শিক্ষা নেন। কুষ্টিয়ার এক দোল পূর্ণিমার অনুষ্ঠানে প্রবল লালনপ্রেমী ও কৃতী গায়ক মোক্ষেদ আলী শায়ের সঙ্গে সাক্ষাৎ তার জীবনের দিক পরিবর্তন করে। লালন সাঁইয়ের দর্শন ও গানের আধ্যাত্মিকতায় তিনি গভীরভাবে উদ্বুদ্ধ হন।
তার গাওয়া লালনের গান শুধু সঙ্গীত নয়, বরং এক আধ্যাত্মিক অনুশীলন। “সত্য বল শূন্য পথে চল” তার জীবনের নৈতিক দিকনির্দেশনার প্রতিফলন। ১৯৭৩ সালে patriotic গান “এই পদ্মা এই মেঘনা” দিয়ে তিনি প্রথমবার খ্যাতি অর্জন করলেও, লালনের গানেই তিনি বাংলাদেশের লোকসঙ্গীতের অমোঘ প্রতীক হয়ে ওঠেন।
“খাঁচার ভিতর অচিন পাখি” ও “মিলন হবে কত দিনে” তার অ্যালবামসমূহ চিরকালীন জনপ্রিয়। তিনি শুধু গান গাইতেন না, বরং নতুন প্রজন্মের সংগীতশিল্পীদের লালনের দর্শন শেখাতে “ফারিদা পারভীন ফাউন্ডেশন” প্রতিষ্ঠা করেন। ধৈর্য, সততা ও নিষ্ঠার মাধ্যমে সঙ্গীত চর্চার গুরুত্ব তিনি বারবার তুলে ধরতেন।
ফারিদা পারভীন ১৯৮৭ সালে একুশে পদক, ১৯৯৩ সালে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার এবং ২০০৮ সালে ফুকুওকা এশিয়ান কালচার প্রাইজসহ অসংখ্য সম্মাননা অর্জন করেন। তিনি সবসময় বলতেন, “আমাদের নতুন প্রজন্ম দীর্ঘমেয়াদি শিক্ষা না নিয়ে shortcuts-এর দিকে ঝুঁকে যাচ্ছে। তাদের সম্মানিত গুরুদের পথ অনুসরণ করা উচিত।”
তার জীবন ও গান বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক ও আধ্যাত্মিক ঐতিহ্যের এক অমর সংরক্ষণ। ফারিদা পারভীনের কণ্ঠ স্থবির হলেও তার সৃষ্ট লালন গানের প্রেরণা ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে অনুপ্রাণিত করে যাবে।