শহুরে জীবনের ব্যস্ততায় দিন কাটানো তরুণ প্রজন্ম এখন এক অজানা শঙ্কার মুখোমুখি। অনেকেই ভেবেছিলেন উচ্চ রক্তচাপ কেবল বয়সের সঙ্গে আসে, কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে দেখা যাচ্ছে, তরুণরাও এই নীরব ঘাতকের শিকার হচ্ছেন। প্রতিদিনের কর্মব্যস্ত রুটিন, যানজট, মানসিক চাপ আর অস্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাসে জড়িয়ে পড়া তরুণেরা চিকিৎসকের কাছে গিয়ে চেকআপ করতে গিয়েই জানতে পারছেন তাঁদের শরীরে অজান্তেই জায়গা করে নিয়েছে উচ্চ রক্তচাপ।
বিশ্বজুড়ে অসংক্রামক ব্যাধির তালিকায় উচ্চ রক্তচাপ অন্যতম। আগে এটি কেবল বয়স্কদের সমস্যা হিসেবে বিবেচিত হলেও এখন তরুণ জনগোষ্ঠীও আক্রান্ত হচ্ছেন সমানভাবে। আন্তর্জাতিক এক গবেষণা অনুসারে ২০ থেকে ৪০ বছর বয়সী প্রতি আট জনের একজন উচ্চ রক্তচাপ রোগে আক্রান্ত। বাংলাদেশের তরুণ সমাজের মধ্যেও এ হার বাড়ছে আশঙ্কাজনকভাবে।
সাধারণত এই রোগের প্রাথমিক লক্ষণগুলো স্পষ্ট হয় না। অনেক সময় মাথা ঘোরা, মাথা বা ঘাড় ব্যথার মতো উপসর্গ দেখা দিলেও অধিকাংশ আক্রান্ত তরুণ কোনো লক্ষণই অনুভব করেন না। এ কারণেই উচ্চ রক্তচাপকে বলা হয় ‘নীরব ঘাতক’। নিয়ন্ত্রণে না থাকলে এটি হার্ট, কিডনি, মস্তিষ্কসহ শরীরের গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গপ্রত্যঙ্গ ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে। হঠাৎ হার্ট অ্যাটাক কিংবা মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণ ঘটিয়ে মৃত্যুর ঝুঁকি তৈরি করে।
গবেষণায় দেখা গেছে, তরুণদের মধ্যে উচ্চ রক্তচাপের কয়েকটি বড় কারণ হলো—স্থূলতা, অস্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস, শরীরচর্চার অভাব, মানসিক চাপ, ধূমপান ও মদ্যপানের অভ্যাস, জিনগত কারণ এবং শারীরিক জটিলতা। অতিরিক্ত ওজন বা স্থূলতা শরীরের হরমোনের ভারসাম্য নষ্ট করে। এর ফলে রক্তনালিতে চর্বি জমে এবং ইনসুলিন রেজিস্ট্যান্স তৈরি হয়, যা উচ্চ রক্তচাপের ঝুঁকি বাড়ায়।
অতিরিক্ত লবণ, প্রক্রিয়াজাত খাবার, ফাস্ট ফুড, তেল-চর্বি ও মিষ্টি জাতীয় খাবারও রক্তচাপ বাড়ায়। তরুণদের মধ্যে দীর্ঘ সময় বসে কাজ করার প্রবণতা, ব্যায়ামের প্রতি অনীহা এবং মানসিক চাপের বোঝা বিষয়টিকে আরও জটিল করছে। এছাড়া পর্যাপ্ত ঘুমের অভাবও এ ক্ষেত্রে বড় ভূমিকা রাখে।
পরিবারে কারও উচ্চ রক্তচাপ থাকলে ঝুঁকি দ্বিগুণ হয়ে যায়। ধূমপান ও মদ্যপান রক্তনালির ক্ষতি করে এবং রক্তচাপ বাড়ায়। পাশাপাশি কিডনি, হৃদরোগ বা হরমোনজনিত অসুস্থতাও উচ্চ রক্তচাপের কারণ হতে পারে। এমনকি কিছু ওষুধ—যেমন ব্যথানাশক বা গর্ভনিরোধক—এই সমস্যাকে বাড়িয়ে দিতে পারে।
তবে আশার কথা হলো, জীবনযাত্রায় পরিবর্তন আনলেই এ সমস্যাকে অনেকাংশে নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব। এর জন্য লবণ ও চর্বিযুক্ত খাবার কমিয়ে সবজি ও শস্য বেশি খাওয়ার অভ্যাস গড়ে তুলতে হবে। প্রতিদিন নিয়মিত শরীরচর্চা, স্বাস্থ্যকর ওজন বজায় রাখা, মানসিক চাপ নিয়ন্ত্রণের কৌশল ব্যবহার, ধূমপান ও মদ্যপান বর্জন—এসবই হতে পারে প্রতিরোধের মূল উপায়।
পরিশেষে বলা যায়, তরুণ বয়সে সুস্থতা ধরে রাখতে হলে সচেতন জীবনযাপন অপরিহার্য। কারণ উচ্চ রক্তচাপ যখন একবার নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়, তখন এর প্রভাব ভয়াবহ হতে পারে। তাই আজ থেকেই স্বাস্থ্যকর অভ্যাস গড়ে তোলা প্রয়োজন, নইলে এই নীরব ঘাতক যেকোনো সময় আঘাত হানতে পারে।