Thursday, November 20, 2025
spot_img
Homeসম্পাদকীয়বন্দিমুক্তি ও যুদ্ধবিরতিতে স্বস্তি এলেও, ট্রাম্পের ‘সোনালী যুগ’-এর প্রতিশ্রুতি এখনো ফাঁপা

বন্দিমুক্তি ও যুদ্ধবিরতিতে স্বস্তি এলেও, ট্রাম্পের ‘সোনালী যুগ’-এর প্রতিশ্রুতি এখনো ফাঁপা

গাজায় যুদ্ধ থেমে যাওয়ার পর এক ঝলক স্বস্তি নেমে এসেছে উভয় পক্ষের মধ্যেই। ইসরায়েলে জীবিত বন্দিদের মুক্তির খবরে আনন্দ ছড়িয়ে পড়েছে পরিবারগুলোর মুখে। অপরদিকে, গাজা ও পশ্চিম তীরে শুরু হয়েছে বন্দি বিনিময় প্রক্রিয়া; প্রায় দুই হাজার ফিলিস্তিনি আটক ব্যক্তি মুক্তি পাচ্ছেন। তবে মুক্তিপ্রাপ্তদের নামের তালিকা ও গন্তব্য নিয়ে দেখা দিয়েছে অনিশ্চয়তা। উত্তর গাজায় বহু মানুষ এখন ফিরে যাচ্ছেন ধ্বংসস্তূপে প্রিয়জনের নিখোঁজ দেহাবশেষ খুঁজে বের করতে — যাদের সংখ্যা আনুমানিক ১০ হাজারেরও বেশি।

তিন সপ্তাহ আগেও এই যুদ্ধবিরতির সম্ভাবনা ছিল প্রায় শূন্য। কিন্তু এখন তা বাস্তব রূপ নিয়েছে। সোমবার যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জেরুজালেমে সংসদে ভাষণ শেষে যান মিশরের শার্ম আল শেখে, যেখানে অনুষ্ঠিত হয় ২০টিরও বেশি দেশের নেতাদের অংশগ্রহণে এক শান্তি সম্মেলন। সেখানে যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে একটি আন্তর্জাতিক শান্তি পরিকল্পনার সূচনা হয়, যার পরবর্তী পর্ব যুক্তরাজ্যেই অনুষ্ঠিত হবে। বলা হচ্ছে, এই চুক্তি বাস্তবায়নে যুক্তরাষ্ট্র ও আন্তর্জাতিক অংশীদাররা বড় ভূমিকা রেখেছেন — যদিও ইসরায়েলের নেতৃত্ব এ প্রক্রিয়ায় তেমন সক্রিয় ছিল না।

অনেকে আশা করছেন, এই যুদ্ধবিরতি ও বন্দিমুক্তির চুক্তি ফিলিস্তিন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পথে প্রথম ধাপ হতে পারে। তবে ইতিহাস বলছে, এমন আশাবাদ অনেক সময়ই ভঙ্গ হয়। চুক্তিতে ফিলিস্তিনিদের সার্বভৌমত্বের কোনো সুস্পষ্ট রূপরেখা নেই, বরং গাজা ও পশ্চিম তীরের বিভাজন আরও গভীর হওয়ার আশঙ্কা রয়ে গেছে। যুদ্ধের পরিধি ও ধ্বংসযজ্ঞ এতটাই ব্যাপক যে পুনর্গঠন এখন সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। ট্রাম্পের পরিকল্পনায় ফিলিস্তিনের স্বাধীনতার কোনো নির্দিষ্ট সময়সূচি না থাকায় তাঁর “সোনালী যুগ” ঘোষণার দাবিও এখন কেবল রাজনৈতিক শ্লোগান হিসেবেই মনে হচ্ছে।

কনেসেটে দেওয়া ভাষণে ট্রাম্প নিজেকে এই চুক্তির একমাত্র নায়ক হিসেবে উপস্থাপন করেন। তিনি দাবি করেন, আগের মার্কিন প্রশাসনগুলো ইসরায়েলকে ‘বিশ্বাসঘাতকতা’ করেছিল, আর তিনিই তাদের ‘সম্মান’ ফিরিয়ে দিয়েছেন। অথচ, এর আগেও আগের প্রশাসন এমন এক যুদ্ধবিরতির পরিকল্পনা করেছিল, যেখানে মানবিক সহায়তা ও রাজনৈতিক আলোচনার ওপর জোর দেওয়া হয়েছিল।

বিশ্লেষকদের মতে, এক পক্ষের ওপর পুরো নিয়ন্ত্রণ আরোপ করে অন্য পক্ষকে প্রান্তিক অবস্থায় রেখে কোনো স্থায়ী শান্তি প্রতিষ্ঠা সম্ভব নয়। যুদ্ধবিরতি ও মানবিক সহায়তার ট্রাকগুলো নিঃসন্দেহে ইতিবাচক পদক্ষেপ, কিন্তু রাজনৈতিকভাবে এটি এখনো বড় কোনো অগ্রগতি নয়। যদি ফিলিস্তিনিদের নিজেদের প্রতিষ্ঠান পরিচালনার সুযোগ ও স্বাধীন অংশগ্রহণের নিশ্চয়তা না থাকে, তবে এই চুক্তি কেবল শান্তির ছদ্মবেশে নিপীড়নকে স্থায়ী করতে পারে।

গাজার জনগণের এখন সবচেয়ে প্রয়োজন মানবিক সহায়তা—খাদ্য ও ওষুধই সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার হওয়া উচিত। তবে পুনর্গঠন প্রক্রিয়া বিলম্বিত হলে পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ হতে পারে। প্রায় ৬ কোটি টন ধ্বংসস্তূপের নিচে পড়ে থাকা গাজা এখন পুনরুদ্ধারের আহ্বান জানাচ্ছে। ঘরবাড়ি, স্কুল, হাসপাতাল, মসজিদ—সবকিছুই ভেঙে চুরমার। এ অবস্থায় গাজার অন্তর্বর্তী প্রশাসনকে শক্তিশালী করতে দ্রুত তহবিল প্রবাহ ও নিরাপত্তা ব্যবস্থার ঘাটতি পূরণ অপরিহার্য।

ট্রাম্পের পরিকল্পনায় আন্তর্জাতিক শান্তিরক্ষী বাহিনী এবং “বোর্ড অব পিস” গঠনের যে প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে, তাতে স্পষ্ট কোনো কাঠামো দেখা যায় না। বরং তা আরও বিভ্রান্তি তৈরি করছে।
বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষকে শক্তিশালী করে হামাসের পরিবর্তে দায়িত্ব গ্রহণের সুযোগ দেওয়াই হতে পারে সবচেয়ে বাস্তবসম্মত সমাধান। গত দুই বছরের অসহনীয় কষ্ট ও প্রাণহানির পর এখন নৈতিকভাবে এই সংঘাতের স্থায়ী সমাধানের দাবিটিই সবচেয়ে জোরালো হয়ে উঠেছে।

যুদ্ধবিরতি, বন্দি বিনিময় এবং হামাসের নিরস্ত্রীকরণের প্রতিশ্রুতি নিঃসন্দেহে ইতিবাচক বার্তা বহন করে। কিন্তু ট্রাম্পের অতীত রেকর্ড দেখে বিশেষজ্ঞরা সন্দিহান — তিনি সত্যিই কি এই শান্তি প্রক্রিয়া সম্পূর্ণ করতে পারবেন? আপাতত এই যুদ্ধবিরতি কিছুটা স্বস্তি এনে দিলেও, ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের স্বপ্ন এখনো অনেক দূরের পথেই রয়ে গেছে।

RELATED ARTICLES

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

- Advertisment -
Google search engine

Most Popular

Recent Comments