গাজায় চলমান সহিংসতা ও জাতিগত নিধন বন্ধে ইসরায়েলের বিরুদ্ধে চাপ সৃষ্টি এবং ফিলিস্তিনকে স্বীকৃতি দেওয়ার দাবিতে ইতালিজুড়ে লাখো মানুষ বিক্ষোভ করেছেন। সোমবার ইতালির রাজধানী রোমসহ দেশটির একাধিক বড় শহরে প্রায় আড়াই লাখ মানুষ রাস্তায় নেমে আসেন। পাশাপাশি কয়েকটি বন্দরেও শ্রমিকরা ধর্মঘট পালন করেন।
ইতালির শ্রমিক সংগঠন ইউএসবি ইউনিয়ন এদিন ২৪ ঘণ্টার সাধারণ ধর্মঘটের ডাক দেয়। সংগঠনটির পক্ষ থেকে ইতালি সরকারের প্রতি ইসরায়েলের সঙ্গে কূটনৈতিক ও বাণিজ্যিক সম্পর্ক ছিন্ন করার আহ্বান জানানো হয়। বিভিন্ন স্থানে বিক্ষোভকারীদের সঙ্গে দাঙ্গা পুলিশের সংঘর্ষের ঘটনাও ঘটে, যদিও কোনো হতাহতের খবর তাৎক্ষণিকভাবে পাওয়া যায়নি।
রোম পুলিশের তথ্যমতে, রাজধানীর প্রধান টার্মিনি রেলস্টেশনের সামনে দুই লাখের বেশি শিক্ষার্থী জড়ো হয়ে বিক্ষোভ করেন। তাদের হাতে ফিলিস্তিনের পতাকা ছিল এবং তারা ‘ফ্রি প্যালেস্টাইন’সহ বিভিন্ন স্লোগান দেন। এই বিক্ষোভের কারণে বাস ও মেট্রো সেবা ব্যাপকভাবে ব্যাহত হয়। রেল সংস্থাগুলো যাত্রা বিলম্ব ও বাতিলের সতর্কবার্তাও জারি করে।
আয়োজকরা জানান, মিলানে প্রায় ৫০ হাজার মানুষ বিক্ষোভে অংশ নেন। বোলোনিয়ার বিভিন্ন সড়কে স্থানীয় পুলিশের হিসাবে অন্তত ১০ হাজার মানুষ একত্রিত হন। তুরিন, ফ্লোরেন্স, নেপলস ও সিসিলিতেও বিক্ষোভ হয়েছে। এ ছাড়া জেনোয়া ও লিভর্নো শহরে বন্দরকর্মীরা বন্দরের প্রবেশপথ অবরোধ করেন।
ইউরোপের বেশিরভাগ দেশ ইতিমধ্যে ফিলিস্তিনকে স্বীকৃতি দিয়েছে। সম্প্রতি যুক্তরাজ্য, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া ও পর্তুগালের স্বীকৃতির পর ফ্রান্সসহ আরও কয়েকটি দেশ একই পথে হাঁটতে চলেছে। এখনো জার্মানি ও ইতালি এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেয়নি। এ প্রেক্ষাপটে লাখো মানুষ ইতালিতে রাস্তায় নেমে সরকারের কাছে ফিলিস্তিনকে স্বীকৃতি দেওয়ার দাবি জানান।
ইতালির প্রধানমন্ত্রী জর্জিয়া মেলোনির নেতৃত্বাধীন সরকার জানিয়েছে, আপাতত তারা ফিলিস্তিনকে স্বীকৃতি দেবে না। সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়, ২০২৩ সালের সেপ্টেম্বরে তারা ইসরায়েলের কাছে অস্ত্র বিক্রি বন্ধ করেছে। তবে বিক্ষোভকারীদের অভিযোগ, ইতালি এখনো ইসরায়েলকে অস্ত্র সরবরাহ করছে। সাম্প্রতিক এক জরিপে দেখা গেছে, দেশটির প্রায় ৪১ শতাংশ নাগরিক ফিলিস্তিনকে স্বীকৃতি দেওয়ার পক্ষে।
জার্মানি, যারা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ইহুদিদের গণহত্যার ইতিহাস বহন করছে, তারা ইসরায়েলের ঘনিষ্ঠ মিত্র হিসেবে জানিয়েছে—স্বীকৃতির আগে শান্তিপূর্ণ আলোচনার প্রক্রিয়া শুরু হওয়া প্রয়োজন। জার্মান পররাষ্ট্রমন্ত্রীর ভাষ্য, প্রথমে প্রক্রিয়া শুরু করতে হবে, তারপরই স্বীকৃতির বিষয়টি বিবেচনায় আসবে।
এদিকে ফ্রান্স ও সৌদি আরব নিউইয়র্কে জাতিসংঘ সদর দপ্তরে এক যৌথ সম্মেলনের আয়োজন করেছে, যার উদ্দেশ্য দ্বিরাষ্ট্রভিত্তিক সমাধানকে এগিয়ে নেওয়া। সম্মেলনে সরাসরি অংশ নেবেন ফরাসি প্রেসিডেন্ট, আর সৌদি যুবরাজ ভার্চ্যুয়ালি যুক্ত হবেন। এ সম্মেলন থেকেই ফ্রান্স, মাল্টা, লুক্সেমবার্গ, বেলজিয়াম, অ্যান্ডোরা ও সান ম্যারিনো একযোগে ফিলিস্তিনকে স্বীকৃতি দেবে বলে আশা করা হচ্ছে। এতে ফিলিস্তিন জাতিসংঘের ১৯৩ সদস্য দেশের মধ্যে ১৫৭টির স্বীকৃতি পাবে।
তবে যুক্তরাষ্ট্র, ইসরায়েল ও তাদের ঘনিষ্ঠ কয়েকটি দেশ সম্মেলনটি বর্জন করেছে। ইসরায়েলের পক্ষ থেকে একে ‘সন্ত্রাসবাদকে পুরস্কৃত করা’র সমতুল্য বলা হয়েছে। এর আগে ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী স্পষ্টভাবে জানান, জর্ডান নদীর পশ্চিম তীরে কোনো ফিলিস্তিন রাষ্ট্র তিনি মেনে নেবেন না।
জাতিসংঘ সম্প্রতি সাত পৃষ্ঠার একটি ঘোষণাপত্র অনুমোদন করেছে, যেখানে দ্বিরাষ্ট্রভিত্তিক সমাধানের জন্য নির্দিষ্ট ও সময়সীমাবদ্ধ পদক্ষেপের কথা বলা হয়েছে। একই সঙ্গে হামাসকে আত্মসমর্পণ ও অস্ত্র সমর্পণের আহ্বান জানানো হয়েছে।
ইতিহাস ঘেঁটে দেখা যায়, ১৯৯৩ সালের অসলো চুক্তি ফিলিস্তিন ও ইসরায়েলের দ্বিরাষ্ট্রভিত্তিক সমাধানের ভিত্তি স্থাপন করেছিল। যদিও ২০১৪ সালের পর থেকে এই প্রক্রিয়া স্থবির হয়ে আছে। সাম্প্রতিক স্বীকৃতির ঢেউ ও আন্তর্জাতিক সম্মেলন আবারও দ্বিরাষ্ট্রভিত্তিক সমাধানের দাবিকে নতুন করে জোরদার করেছে।