সিলেটের সাদাপাথর ও জাফলংসহ বিভিন্ন এলাকায় পাথর লুটের ঘটনা নিয়ে দেশব্যাপী আলোড়ন এখনও পুরোপুরি স্তিমিত হয়নি। এরই মধ্যে নগর ও জেলার অন্তত ৩৪টি স্থানে প্রকাশ্যে টিলা কাটার খবর পাওয়া গেছে। খাদিমপাড়া, জৈন্তাপুর, কোম্পানীগঞ্জ, গোয়াইনঘাটসহ বিস্তীর্ণ এলাকায় টিলা ধ্বংসের ভয়াবহ চিত্র স্পষ্ট হয়ে উঠছে। এসব টিলার প্রায় ৭০ শতাংশ ব্যক্তিমালিকানাধীন, আর বাকিগুলো সরকারি খাসজমি।
মাসের পর মাস প্রকাশ্যে পাথর লুট হলেও সময়মতো প্রশাসনের কার্যকর উদ্যোগ না নেওয়ায় পরিস্থিতি আরও জটিল হয়েছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সমালোচনার ঝড় উঠলে নামমাত্র কিছু অভিযান চালানো হয়, যা সাধারণ মানুষকে সন্তুষ্ট করতে পারেনি। এখন টিলা কাটার ঘটনাও একই পথে এগোচ্ছে। প্রতিদিন শ্রমিকদের দিয়ে টিলা সমতল করা হলেও প্রশাসনের দৃশ্যমান তৎপরতা চোখে পড়ছে না।
স্থানীয় সূত্র জানায়, টিলা কাটার সঙ্গে প্রভাবশালী মহল জড়িত। নির্দিষ্ট টাকার বিনিময়ে শ্রমিক নিয়োগ করে টিলা সমতল করা হচ্ছে। পরিবেশ অধিদপ্তরের মামলায় অভিযুক্তদের অনেকেই রাজনৈতিক দলের স্থানীয় পর্যায়ের নেতৃত্বে রয়েছেন। একাধিক মামলা হলেও কার্যত টিলা কাটার প্রবণতা থামেনি।
বাংলাদেশ পরিবেশ সংরক্ষণ আইন, ১৯৯৫-এর ৬(খ) ধারায় স্পষ্টভাবে বলা আছে—সরকারি বা ব্যক্তিমালিকানাধীন পাহাড়, টিলা কিংবা অনুরূপ ভৌগোলিক গঠন কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান কর্তন করতে পারবে না। অথচ প্রশাসনের উদাসীনতা এই আইনের কার্যকারিতা প্রশ্নবিদ্ধ করেছে। পরিবেশবাদী সংগঠনগুলোর তথ্য বলছে, গত আড়াই দশকে সিলেট অঞ্চলের অন্তত ৩০ শতাংশ টিলা নিশ্চিহ্ন হয়েছে। বিশেষ করে গত এক বছরে আগের তুলনায় কয়েক গুণ বেশি টিলা কেটে ফেলা হয়েছে। আগে যেটা রাতের আঁধারে হতো, এখন সেটাই দিনের আলোয় প্রকাশ্যে ঘটছে।
টিলা কাটার কারণে বন্যা ও ভূমিধসের ঝুঁকি বহুগুণ বেড়েছে। অতীতে ভূমিধসে বহু প্রাণহানি ঘটেছে; এখনো হাজারো পরিবার ঝুঁকির মধ্যে বসবাস করছে। সরকারি নিষ্ক্রিয়তা ও রাজনৈতিক ছত্রচ্ছায়া সিলেটের টিলাগুলোকে ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে ঠেলে দিয়েছে।
এই পরিস্থিতিতে কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া ছাড়া বিকল্প নেই। দোষীদের সর্বোচ্চ আইনি শাস্তি নিশ্চিত করা, স্থানীয় জনগণকে সম্পৃক্ত করে সচেতনতা বৃদ্ধি, বিকল্প কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি এবং দীর্ঘমেয়াদি পরিবেশ সংরক্ষণ পরিকল্পনা গ্রহণ জরুরি হয়ে পড়েছে। প্রশাসন, আইন এবং নাগরিক সচেতনতা—এই তিন স্তম্ভ ছাড়া টিলাকে রক্ষা করা সম্ভব নয়।
সিলেটের জেলা প্রশাসক জানিয়েছেন, প্রকৃতি ও পরিবেশ রক্ষায় কোনো ছাড় দেওয়া হবে না এবং টিলা কাটায় জড়িতদের বিরুদ্ধে দ্রুত অভিযান চালানো হবে। তবে এই আশ্বাসের বাস্তব প্রয়োগ এখন সময়ের দাবি।