নিরব, শান্ত এবং প্রলেপমুক্ত জলের ভেতর দিয়ে হেলেদুলে এগিয়ে গেল পৃথিবীর সবচেয়ে বড় প্রজাতির মাছ হোয়েল শার্ক। পাশে উড়ছে মান্টা রে, গম্ভীর অভিজাত ভঙ্গিতে ভেসে চলেছে জায়ান্ট গ্রুপার। শান্ত কচ্ছপ আর ডোরাকাটা হাঙরের সঙ্গে ঢেউয়ের মতো নাচছে গোমুখো রে। মাথার ওপর ঝাঁকে ঝাঁকে উল্লাস করছে রুপালি টারপন। যেন এক মুহূর্তেই আটলান্টিক মহাসাগরের গভীরে চলে গিয়েছি।
যুক্তরাষ্ট্রের একটি বৃহত্তম বেসরকারি অ্যাকুয়ারিয়ামে প্রবেশ করার পর এই অভিজ্ঞতা আরও বাস্তব হয়ে উঠেছে। ২০০৫ সালে প্রতিষ্ঠিত এই স্থাপনাটি ২০১২ সাল পর্যন্ত বিশ্বের সবচেয়ে বড় অ্যাকুয়ারিয়ামের খেতাব ধরে রেখেছিল। প্রায় আট হেক্টর বিস্তৃত এই জায়গায় সাতটি মূল গ্যালারি রয়েছে, যেখানে ৪ কোটি ২০ লাখ লিটার পানিতে ৫০০ প্রজাতির এক লাখের বেশি জলজ প্রাণী বাস করছে।
সকালে দীর্ঘ লাইন পার হয়ে সকাল ৯টায় প্রবেশ। প্রথমেই দর্শকের সামনে আসে ‘ওসান ভয়েজার’ নামের স্বচ্ছ কাচের টানেল। ভেতরে ঢুকলেই মনে হয় যেন ডুবুরি হয়ে আটলান্টিক মহাসাগরে নামছি। ছোট থেকে বড় সকল দর্শকই বিস্ময়ে চোখ কেমন করে খুলে রাখে। সঙ্গে আমার নাতনি নোরা, তাঁর মা, নানু ও পরিবারের অন্যান্য সদস্য।
ওসান ভয়েজারের পর একে একে দর্শকদের সামনে আসে সাতটি গ্যালারি। কোল্ড ওয়াটার কোয়েস্টে ধবধবে সাদা বেলুগা হোয়েল, আফ্রিকান পেঙ্গুইন, জাপানি স্পাইডার ক্র্যাব। ট্রপিক্যাল ডাইভার গ্যালারিতে চোখ ধাঁধানো রঙের ক্লাউনফিশ, জেলিফিশ ও গার্ডেন ইল। রিভার স্কাউট গ্যালারি দেখায় জর্জিয়া থেকে আফ্রিকা পর্যন্ত নানা নদীর প্রাকৃতিক বৈচিত্র্য। পিয়ের ২২৫ গ্যালারিতে হাস্যোজ্জ্বল সি লায়নদের কসরত। প্রিডেটরস অব দ্য ডিপে দেখা মিলছে টাইগার শার্ক এবং গ্রেট হ্যামারহেডের।
এই সাতটি গ্যালারি যেন পৃথিবীর সাত মহাদেশের জলজ প্রাণীর মহাসম্মিলন। দর্শকরা শুধু তাদের সৌন্দর্য দেখছে না, বরং ধারাভাষ্যকারদের ব্যাখ্যা শুনে প্রাণীদের জীবনচক্র ও বাসস্থানের তথ্যও পাচ্ছে। প্রতিটি পোস্টার, প্ল্যাকার্ড এবং ধারাভাষ্য এক বার্তা দিয়ে যাচ্ছে—এই প্রাণীরা আমাদের পৃথিবীর অবিচ্ছেদ্য অংশ, আমাদের ভালোবাসা ও সুরক্ষা প্রাপ্য।
দুপুরের খাবারের পর আমরা গেলাম ‘ডলফিন কোস্টে’। বিশাল অডিটরিয়ামে একসাথে ১,৮৮০ দর্শক ডলফিনের শো উপভোগ করতে পারবে। আধঘণ্টার শোতে ডলফিনরা মানুষের নির্দেশে জলের ওপর নাচছে, ডিগবাজি দিচ্ছে। ট্রেইনারদের দক্ষতার সঙ্গে ডলফিনের কসরত মিলে দর্শকদের চমকে দেয়। এক মুহূর্তে একজন পারফরমার পানিতে ঝাঁপ দিয়ে ডলফিনের মাধ্যমে দ্রুতগতিতে উপরে চলে আসে—দর্শকরা উল্লাসে ভরে ওঠে।
জুলাইয়ের বিকেল দীর্ঘ হলেও নতুন নতুন চমক উপভোগ করা শেষ হয়নি। ডলফিনের কসরত, ডুবুরিদের নৃত্য, আলোর ঝলকানি এবং সংগীতের সঙ্গে শিল্পীদের নিখুঁত পারফরম্যান্স সব মিলিয়ে দর্শনীয় অভিজ্ঞতা। সন্ধ্যা নামার পরও অ্যাকুয়ারিয়ামের জগৎ আলোয় আলোয় উদ্ভাসিত থাকে। প্রস্থান করার সময় এক কর্মী বললেন, ‘পৃথিবীর সব প্রাণীকে ভালোবাসতে শিখুন। এমন কোনো কাজ করবেন না যা তাদের ক্ষতি করে।’ তাঁর কথাগুলো মনে করিয়ে দেয় আমাদের প্রাকৃতিক জগতের সঙ্গে সংহতি ও সুরক্ষার মূল্য।