বিশ্বজুড়ে উত্তেজনা এখন নোবেল শান্তি পুরস্কার নিয়ে। প্রতি বছরই অক্টোবর মাসে এই পুরস্কারের ঘোষণা আসে, আর এ বছরও তার ব্যতিক্রম নয়। শুক্রবার স্থানীয় সময় বেলা ১১টায় (০৯০০ জিএমটি) নরওয়ের নোবেল কমিটি জানাবে কে পাচ্ছেন ২০২৫ সালের শান্তির নোবেল। তবে একটি বিষয় ইতিমধ্যেই স্পষ্ট—যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প এ বছর এই পুরস্কার পাচ্ছেন না, যদিও তিনি নিজেকে দীর্ঘদিন ধরেই এই মর্যাদার যোগ্য দাবি করে আসছেন।
বিশ্বের বর্তমান পরিস্থিতি অস্থির ও সংঘাতপূর্ণ। সুইডেনের উপসালা বিশ্ববিদ্যালয়ের তথ্যমতে, ১৯৪৬ সালে বিশ্ব সংঘাতের তথ্য সংরক্ষণ শুরু হওয়ার পর থেকে এ বছর পর্যন্ত এত বেশি রাষ্ট্রীয় সশস্ত্র সংঘাত আর কখনো দেখা যায়নি। এমন প্রেক্ষাপটে নোবেল কমিটির সিদ্ধান্তের দিকে তাকিয়ে আছে পুরো বিশ্ব।
ট্রাম্প দাবি করেছেন, তিনি আটটি বড় সংঘাতের অবসান ঘটিয়েছেন, ফলে শান্তির জন্য তিনিই সবচেয়ে যোগ্য। কিন্তু আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশেষজ্ঞদের মতে, তাঁর সেই দাবি বাস্তবতার সঙ্গে মেলে না। বিশেষজ্ঞরা বলেন, “এ বছর তাঁর নাম বিবেচনায় আসছে না। হয়তো পরের বছর তাঁর কিছু কূটনৈতিক পদক্ষেপের ফলাফল পরিষ্কার হলে বিষয়টি আবার আলোচনায় আসতে পারে।”
অন্যদিকে গবেষক ও বিশ্লেষকেরা মনে করেন, ট্রাম্পের অনেক সিদ্ধান্তই নোবেল পুরস্কারের মূল নীতির বিপরীত। ‘আমেরিকা ফার্স্ট’ নীতিতে তিনি যুক্তরাষ্ট্রকে বহু আন্তর্জাতিক সংস্থা ও চুক্তি থেকে প্রত্যাহার করেছেন, বহু দেশের সঙ্গে বাণিজ্যযুদ্ধ শুরু করেছেন, এমনকি আন্তর্জাতিক সহযোগিতা ও মানবাধিকার প্রশ্নেও বিতর্ক তৈরি করেছেন। এই সবকিছুই তাঁকে নোবেলের দর্শন থেকে দূরে সরিয়ে দিয়েছে।
নোবেল কমিটির চেয়ারম্যানের মতে, বিজয়ী নির্বাচন করার সময় শুধু কোনো ব্যক্তির বক্তব্য নয়, তার সামগ্রিক ভূমিকা ও অর্জন বিবেচনা করা হয়। “আমরা দেখি কেউ বাস্তবে শান্তির জন্য কী অবদান রেখেছে,” এমনটাই তাঁর বক্তব্য।
এ বছর শান্তি পুরস্কারের জন্য মনোনীত হয়েছেন ৩৩৮ ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান। এই তালিকা আগামী ৫০ বছর পর্যন্ত গোপন রাখা হবে। সাধারণত সংসদ সদস্য, মন্ত্রিসভার সদস্য, আগের নোবেল বিজয়ী এবং নির্বাচিত বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপকরা প্রার্থীদের নাম প্রস্তাব করার অধিকার রাখেন।
গত বছর শান্তি পুরস্কার পেয়েছিল জাপানের পারমাণবিক বোমা হামলায় বেঁচে যাওয়া ব্যক্তিদের সংগঠন ‘নিহোন হিদানকিও’। তারা বহু বছর ধরে পারমাণবিক অস্ত্র নিষিদ্ধে কাজ করে আসছে।
তবে এ বছর এখনো স্পষ্ট কোনো প্রার্থীকে এগিয়ে রাখতে পারছে না পর্যবেক্ষকেরা। সম্ভাব্য নামগুলোর মধ্যে আছে সুদানের ‘ইমার্জেন্সি রেসপন্স রুমস’—যারা যুদ্ধ ও দুর্ভিক্ষের মধ্যে মানবিক সহায়তা দিয়ে যাচ্ছে। এছাড়া আলোচনায় আছেন প্রয়াত রুশ নেতা অ্যালেক্সি নাভালনির স্ত্রী ইউলিয়া নাভালনায়া, আন্তর্জাতিক নির্বাচন পর্যবেক্ষণ সংস্থা ‘অফিস ফর ডেমোক্রেটিক ইনস্টিটিউশনস অ্যান্ড হিউম্যান রাইটস’ এবং মানবাধিকার রক্ষায় কাজ করা কয়েকটি সংস্থা।
নরওয়ের আন্তর্জাতিক বিষয়ক বিশ্লেষকেরা বলছেন, সাম্প্রতিক বছরগুলোতে নোবেল কমিটি আবারও “ক্ল্যাসিক শান্তি” ধারার দিকে ফিরেছে। মানবাধিকার, গণতন্ত্র, সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা এবং নারী অধিকার এখন তাদের পুরস্কারের কেন্দ্রে।
তাঁদের ধারণা, এ বছর এমন একজন বা একটি সংস্থা নির্বাচিত হবে, যারা বিতর্কমুক্ত এবং মানবতার স্বার্থে বাস্তব ভূমিকা রেখেছে। সম্ভাব্য প্রার্থীদের তালিকায় জাতিসংঘের শরণার্থী সংস্থা (UNHCR), ফিলিস্তিনের সহায়তা সংস্থা (UNRWA), এমনকি আন্তর্জাতিক বিচার আদালত (ICJ) এবং আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের (ICC) নামও আছে।
বিশ্বজুড়ে সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা সংকুচিত হওয়ায়, অনেকেই মনে করছেন এই বছর পুরস্কার পেতে পারে সাংবাদিক নিরাপত্তা সংগঠন ‘কমিটি টু প্রটেক্ট জার্নালিস্টস’ বা ‘রিপোর্টার্স উইদাউট বর্ডার্স’।
তবে ইতিহাস বলছে, নোবেল কমিটি প্রায়ই সবাইকে চমকে দেয়। হয়তো এবারও এমন একজন বা একটি সংগঠনের নাম আসবে, যার কথা কেউ ভাবেনি—আর সেই চমকেই নতুন করে আলোচনায় আসবে শান্তির নোবেল।



