Thursday, November 20, 2025
spot_img
Homeভ্রমণ টুকিটাকিনেমরুত পর্বতের রহস্য: দুই হাজার বছরের পুরনো পাথরের দেবতা পাহারা দিচ্ছে এক...

নেমরুত পর্বতের রহস্য: দুই হাজার বছরের পুরনো পাথরের দেবতা পাহারা দিচ্ছে এক রাজ্যের স্বপ্ন

তুরস্কের আদিয়ামান প্রদেশের আকাশ ছুঁয়ে থাকা নেমরুত পর্বত— সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে প্রায় দুই হাজার মিটার উঁচু। নিচের দিকে জলপাই গাছের সারি, আর উপরে উঠে গেলে কেবল পাথর আর ধুলোবালির ঢাল। দূর থেকে দেখতে সাধারণ পাহাড় মনে হলেও, শীর্ষের কাছে পৌঁছালে চমকে উঠতে হয় — কারণ সেখানে নীরবে বসে আছে বিশালাকৃতির পাথরের দেবতাদের মাথা।

এই বিশাল পাথরের মুখগুলো শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে ভূমিকম্প, তুষার আর প্রখর রোদের আঘাতে ক্ষয়ে গেছে, কিন্তু এখনো তারা যেন পাহারা দিচ্ছে সেই পাহাড়চূড়া। নিচে ছাগলরা ঘাস খাচ্ছে, আর চারপাশে বইছে শীতল বাতাস।

এই অসাধারণ স্থাপনার পেছনে ছিলেন কোম্মাগেন রাজ্যের শাসক রাজা আনতিওখাস। প্রায় দুই হাজার বছর আগে আলেকজান্ডার দ্য গ্রেটের সাম্রাজ্য ভেঙে যাওয়ার পর এই অঞ্চলে গড়ে ওঠে কোম্মাগেন নামের এক ক্ষুদ্র কিন্তু সমৃদ্ধ রাজ্য, যেখানে গ্রিক, পারস্য, আসিরীয় ও আর্মেনীয় সংস্কৃতির মিশেল ঘটেছিল। রাজা আনতিওখাস চেয়েছিলেন মৃত্যুর পরও নিজের অস্তিত্ব অমর করে রাখতে। তাই তিনি নির্মাণ করেছিলেন এক পাহাড়চূড়ায় বিশাল সমাধি— যেখানে দেবতাদের সঙ্গে তিনি নিজেকেও স্থাপন করেছিলেন পাথরে খোদাই করে।

কিন্তু সময় ও প্রকৃতি থেমে থাকেনি। এখন সেই মূর্তিগুলোর মাথা আলাদা হয়ে পড়ে আছে, তবুও পাহাড়চূড়াকে পাহারা দিচ্ছে। স্থানীয়রা একে বলে “দেবতাদের সিংহাসন”।

নেমরুত পর্বতের চূড়া থেকে দক্ষিণ তুরস্কের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য দেখা যায় চোখ মেলে। সূর্যোদয় আর সূর্যাস্তের সময়ে দৃশ্যটা হয় আরও মনোমুগ্ধকর। তবে দর্শনার্থীরা এখানে আসেন শুধু দৃশ্য নয়, ইতিহাসের গভীর রহস্যের খোঁজে।

পর্বতের দিকে যাত্রা শুরু হয় আদিয়ামানের কাহতা জেলা থেকে। প্রায় ৫০ মিনিটের পথ গাড়িতে বা হাঁটায় অতিক্রম করা যায়। পথে দেখা মেলে শতবর্ষ ধরে চলা গ্রামীণ জীবনের — রাস্তার ধারে ছাগল ও গরুর পাল, প্রাচীন পাথরের সেতু “সেপ্টিমিয়াস সেভেরাস ব্রিজ” এবং কোম্মাগেন রাজপরিবারের নারীদের স্মৃতিতে নির্মিত কারাকুশ টুমুলাস।

আরও উঁচুতে আছে আর্সেমিয়া ধ্বংসাবশেষ, যেখানে ক্লিফে খোদাই করা রয়েছে প্রাচীন গ্রিক ভাষায় দীর্ঘতম শিলালিপিগুলোর একটি, আর পাশে রাজা মিত্রিদাতেসের দেবতা হেরাক্লেসের সঙ্গে করমর্দনের দৃশ্য।

চূড়ার কাছে পৌঁছাতে শেষ ২৫ মিনিটের খাড়া পথ পাড়ি দিতে হয়। প্রায় ৩০০ সিঁড়ি বেয়ে উঠতে হয় ৫০০ মিটার দূরত্বে। উঠতে উঠতে পাতলা হতে থাকে বাতাস, নিচে মিলিয়ে যায় পৃথিবী। একসময় চোখে পড়ে বিশাল মানবনির্মিত টিলা— রাজা আনতিওখাসের সমাধিস্থল বলে ধারণা করা হয় যাকে।

প্রাচীন কোম্মাগেন রাজ্য এক অনন্য সাংস্কৃতিক সংমিশ্রণ তৈরি করেছিল। নেমরুতের মূর্তিগুলোতেও দেখা যায় সেই সংমিশ্রণ— গ্রিক দেবতা জিউস, অ্যাপোলো, হেরাক্লেসের সঙ্গে রয়েছে স্থানীয় উর্বরতার দেবী ও রাজা আনতিওখাস নিজে। প্রায় ১৫ মিটার উচ্চতার এই পাথরের মূর্তিগুলো নির্মিত হয়েছিল রাজাকে অমর করে রাখতে।

কিন্তু রোমানদের দখলের পর রাজ্য বিলীন হয়ে গেলে এই স্থান পরিণত হয় নিঃসঙ্গ ধ্বংসাবশেষে। এখন সেই ছিন্নমস্তক মূর্তিগুলো যেন ইতিহাসের নিঃশব্দ সাক্ষী।

নেমরুতের শীর্ষে প্রায় ৫০ মিটার উঁচু টিলা বা টুমুলাসে রাজা আনতিওখাসের সমাধি আছে বলে বিশ্বাস করা হয়, যদিও শতাধিক বছর ধরে গবেষকরা খুঁজেও সেটি আবিষ্কার করতে পারেননি। ১৮৮১ সালে একজন জার্মান প্রকৌশলী প্রথম এই স্থানের কথা জানান, পরে এক মার্কিন প্রত্নতত্ত্ববিদ আজীবন অনুসন্ধান চালালেও সমাধি চেম্বার খুঁজে পাননি।

১৯৮৭ সালের পর থেকে স্থানে কোনো খনন অনুমোদন করা হয়নি, যেন রহস্য অক্ষুণ্ণ থাকে। স্থানীয় গাইডদের মতে, এই নিষেধাজ্ঞাই রাজা আনতিওখাসের “গোপন চেম্বার”কে সময় ও লুটেরাদের হাত থেকে সুরক্ষিত রেখেছে।

বর্তমানে নেমরুতকে জাতীয় উদ্যান হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে। পাথরের মূর্তিগুলোর সংরক্ষণের জন্য আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করা হচ্ছে, যেমন “ন্যানো লাইম” ইনজেকশন যা ফাটল রোধ করে ও আবহাওয়ার ক্ষতি থেকে রক্ষা করে।

চূড়ায় তিনটি টেরেস বা প্রাঙ্গণ রয়েছে— পূর্ব, উত্তর ও পশ্চিম। পূর্ব অংশে দেবতা, রাজার বংশীয় প্রতীক ও উৎসর্গ বেদি দেখা যায়। পশ্চিমে শতাব্দীর ভূমিকম্প ও ক্ষয়ের কারণে মূর্তিগুলো ছিন্নভিন্ন হয়ে পড়ে আছে, যা আজ তুরস্কের অন্যতম প্রতীকী দৃশ্য।

একটি বিশেষ সিংহের রিলিফে দেখা যায় তারা ও অর্ধচন্দ্র চিহ্ন, যা বিশ্বের প্রাচীনতম জ্যোতিষ ক্যালেন্ডি বলে ধরা হয়। এটি রাজা আনতিওখাসের রাজ্যাভিষেকের তারিখ ৭ জুলাই, খ্রিষ্টপূর্ব ৬২ নির্ধারণ করে।

প্রাচীন গ্রিক ভাষায় খোদাই করা ২৩৭টি শিলালিপিতে উল্লেখ আছে রাজা আনতিওখাসের দেবত্ব, আইন এবং ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কাছে তাঁর পূজার অনুরোধ।

চূড়া থেকে নিচে তাকালে দেখা যায় দক্ষিণে ইউফ্রেটিস নদীর উপত্যকা আর উত্তরে টরাস পর্বতমালা। সূর্যাস্তের সময়, যখন আলো ধীরে ধীরে ম্লান হয়, পাথরের দেবতারা যেন লালচে আভায় জেগে ওঠে— আরেকবার স্মরণ করিয়ে দেয় দুই হাজার বছর আগের এক রাজ্যের অমর গৌরব।

RELATED ARTICLES

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

- Advertisment -
Google search engine

Most Popular

Recent Comments