দক্ষিণ গোলার্ধের ওশেনিয়া অঞ্চলে অবস্থিত মনোরম প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের দেশ নিউজিল্যান্ড, যাকে অনেকে “শুভ্র মেঘের দেশ” বা “সিলভার ফার্নের দেশ” বলেও চেনেন। বিশ্বের অন্যতম শান্তিপূর্ণ ও দুর্নীতিমুক্ত এই দেশটি শুধু প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের জন্য নয়, বরং এর আধুনিক ও মানসম্মত শিক্ষাব্যবস্থার জন্যও বিশ্বব্যাপী পরিচিত।
একজন শিক্ষা পরামর্শক জানান, নিউজিল্যান্ডের উচ্চশিক্ষাব্যবস্থা তার আধুনিকতা, গবেষণার সুযোগ এবং শিক্ষার্থী-বান্ধব পরিবেশের কারণে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে প্রশংসিত। এখানকার বিশ্ববিদ্যালয়গুলো প্রতি বছরই বিশ্বের সেরা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের তালিকায় স্থান করে নেয়। শুধু পাঠ্যপুস্তকভিত্তিক জ্ঞান নয়, বাস্তব জীবনের সমস্যা সমাধান, উদ্ভাবনী চিন্তা ও গবেষণার মাধ্যমে শিক্ষার্থীদেরকে বিশ্বমানের দক্ষ নাগরিক হিসেবে গড়ে তোলে দেশটির শিক্ষাব্যবস্থা।
ক্যারিয়ার সম্ভাবনার কথা বলতে গিয়ে ওই পরামর্শক বলেন, নিউজিল্যান্ডের শিক্ষা কাঠামো এমনভাবে তৈরি যে, এটি সরাসরি বৈশ্বিক চাকরির বাজারের সঙ্গে সংযুক্ত। বিজ্ঞান, প্রকৌশল, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি, ব্যবসায় প্রশাসন, চিকিৎসাবিজ্ঞানসহ বিভিন্ন খাতে এখানকার ডিগ্রি আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত। ফলে, এখানকার স্নাতকেরা সহজেই বিশ্বের বিভিন্ন দেশে কর্মসংস্থানের সুযোগ পান।
শিক্ষার মানের দিক থেকে নিউজিল্যান্ডের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো দীর্ঘদিন ধরে বিশ্বের শীর্ষস্থানীয় প্রতিষ্ঠানের মধ্যে রয়েছে। ইউনিভার্সিটি অব অকল্যান্ডসহ দেশের সবগুলো বিশ্ববিদ্যালয়ই কিউএস ও টাইমস হায়ার এডুকেশন র্যাঙ্কিং অনুযায়ী বিশ্বের প্রথম ৫০০ বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে অবস্থান করছে। উচ্চশিক্ষা শেষে প্রায় ৯৩ শতাংশ শিক্ষার্থী দ্রুত কর্মজীবনে প্রবেশ করেন—যা দেশটির শিক্ষা মান ও কার্যকারিতারই প্রমাণ।
যাঁরা স্থায়ীভাবে বসবাস করতে চান, তাঁদের জন্য গবেষণামূলক শিক্ষা বা পিএইচডি একটি আদর্শ পথ। পিএইচডি শিক্ষার্থীরা পড়াশোনার পাশাপাশি পূর্ণ সময় কাজ করার অনুমতি পান, এবং গবেষণা শেষে অতিরিক্ত দুই বছর কাজের সুযোগও দেওয়া হয়। সবচেয়ে বড় সুবিধা হলো, দেশি ও বিদেশি শিক্ষার্থীদের জন্য টিউশন ফিতে কোনো পার্থক্য নেই। বছরে মাত্র প্রায় চার হাজার ডলারে পিএইচডি সম্পন্ন করা সম্ভব, আর বিশ্ববিদ্যালয় বা সরকারের সহায়তা পেলে অনেক সময় বিনা খরচেও পড়াশোনা করা যায়।
খণ্ডকালীন কাজের সুযোগও এখানে প্রশংসনীয়। স্নাতক ও স্নাতকোত্তর শিক্ষার্থীরা সপ্তাহে গড়ে ২৫ থেকে ৪০ ঘণ্টা পর্যন্ত কাজ করতে পারেন। গবেষণারত শিক্ষার্থীদের জন্য সময়ের কোনো সীমাবদ্ধতা নেই, এমনকি তাঁদের জীবনসঙ্গীরাও ফুলটাইম কাজের অনুমতি পান।
নিউজিল্যান্ডে পড়াশোনা শেষে স্থায়ী বসবাসের সুযোগও রয়েছে। সাধারণত দুই থেকে তিন বছর কাজের অভিজ্ঞতা অর্জনের পর স্থায়ী নাগরিকত্বের জন্য আবেদন করা যায়। এই সুবিধা খুব কম দেশেই পাওয়া যায়।
ভর্তির প্রক্রিয়াও বেশ সহজ ও নমনীয়। সরকার শিক্ষায় বড় অঙ্কের অর্থ বিনিয়োগ করায় বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর আসনসংখ্যা পর্যাপ্ত। পূর্বের পড়াশোনা যদি ইংরেজি মাধ্যমে হয়ে থাকে, তাহলে ভাষা পরীক্ষার শর্ত থেকেও ছাড় পাওয়া যায়। স্নাতক পর্যায়ে আইইএলটিএস স্কোর প্রয়োজন ৫.৫ থেকে ৬.০ এবং স্নাতকোত্তর পর্যায়ে ৬.০ থেকে ৬.৫। আর্লি চাইল্ডহুড এডুকেশন বিষয়ে পড়তে চাইলে প্রয়োজন ৭.০ স্কোর। ভিসার ক্ষেত্রেও জটিলতা কম, প্রায় ৪০ থেকে ৫০ লাখ টাকার ব্যাংক স্টেটমেন্ট ও একটি স্পষ্ট উদ্দেশ্যপত্রই যথেষ্ট।
নিউজিল্যান্ডে ইউরোপীয় ধাঁচের শিক্ষাব্যবস্থা অনুসৃত হয়। ডিপ্লোমা, ব্যাচেলর, মাস্টার্স এবং ডক্টরাল—সব ধরণের উচ্চশিক্ষার সুযোগ রয়েছে। ইংরেজি ভাষায় পাঠদান হওয়ায় আইইএলটিএস, পিটিই বা টোফেল স্কোর জমা দিতে হয়।
প্রতিবছর সরকার ও বিশ্ববিদ্যালয়গুলো বিদেশি শিক্ষার্থীদের জন্য পূর্ণ বা আংশিক বৃত্তি দেয়, যার মাধ্যমে শিক্ষার ব্যয় অনেকটাই কমে যায়। এর মধ্যে রয়েছে নিউজিল্যান্ড ইন্টারন্যাশনাল স্কলারশিপ, অকল্যান্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের এক্সিলেন্স স্কলারশিপ, ওয়েলিংটন বিশ্ববিদ্যালয়ের রিসার্চ স্কলারশিপ, ওটাগো ও ওয়াইকাটো বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক বৃত্তি প্রোগ্রাম।
দেশটির জীবনধারা অত্যন্ত সুশৃঙ্খল ও নিরাপদ। শিক্ষার্থীরা পড়াশোনার পাশাপাশি সাংস্কৃতিক কার্যক্রম, ভ্রমণ ও ক্লাব অংশগ্রহণের সুযোগ পান। মনোরম আবহাওয়া, আধুনিক শিক্ষা, সাশ্রয়ী জীবনযাত্রা ও নিরাপদ পরিবেশ—সব মিলিয়ে নিউজিল্যান্ড বিশ্বজুড়ে উচ্চশিক্ষা ও ক্যারিয়ারের স্বপ্নপূরণের এক অনন্য গন্তব্য হয়ে উঠেছে।



