ভারতের রাজধানী দিল্লি ও আশপাশের এলাকায় পথের কুকুর বা ‘স্ট্রে ডগ’ নিয়ে বিতর্ক এখন নতুন এক পর্যায়ে পৌঁছেছে। শহরের রাস্তায় ঘুরে বেড়ানো এই কুকুরগুলো অনেকের কাছে পরিবারের মতো, আবার অনেকের কাছে আতঙ্কের কারণ।
দক্ষিণ দিল্লির এক আবাসিক এলাকার নারী, যিনি নিজেকে ৪০টিরও বেশি কুকুরের ‘দাদি’ বলে পরিচয় দেন, প্রতিদিন তাদের খাবার দেন এবং নিয়মিত টিকাদানও করান। তাঁর সঙ্গে আরও কিছু স্বেচ্ছাসেবী যুক্ত রয়েছেন—যারা নিজেদের এলাকার পথের কুকুরগুলোর যত্ন নেন। কেউ টিকা দেন, কেউ খাবার দেন, আবার কেউ চিকিৎসার ব্যবস্থা করেন।
তারা যেসব কুকুরের যত্ন নেন, সেগুলোকে স্থানীয়ভাবে বলা হয় “ইন্ডিজ” বা ভারতীয় দেশি প্রজাতি। এই কুকুরগুলো সাধারণত বুদ্ধিমান, সহনশীল এবং শহরের কঠিন পরিবেশে টিকে থাকতে সক্ষম। কিন্তু জনসংখ্যা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে এই প্রাণীগুলোর সংখ্যা নিয়ন্ত্রণ ও তাদের সুরক্ষার বিষয়টি এখন এক বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
গত আগস্টে ভারতের সর্বোচ্চ আদালত এক নির্দেশে রাজধানী অঞ্চলের সব পথের কুকুরকে নির্বীজকরণের পর স্থায়ীভাবে আশ্রয়কেন্দ্রে স্থানান্তরের নির্দেশ দেয়। আদালতের যুক্তি ছিল—কুকুরের কামড়ে আহত হওয়া এবং জলাতঙ্কের (র্যাবিস) ঝুঁকি কমাতে এই পদক্ষেপ প্রয়োজন। কিন্তু সিদ্ধান্তের পরপরই দেশজুড়ে প্রতিবাদ শুরু হয়। প্রাণীপ্রেমীরা এই সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়ে পুলিশবিরোধী আন্দোলনও করেন।
প্রচণ্ড সমালোচনার মুখে পড়ে আদালত কয়েকদিন পর নির্দেশ সংশোধন করে জানায়—সব কুকুরকে নির্বীজকরণ ও টিকাদান শেষে তাদের নিজ নিজ এলাকায় ফিরিয়ে দিতে হবে। তবে প্রাণী অধিকার কর্মীদের দাবি, এই পরিবর্তনই উল্টো পরিস্থিতি আরও জটিল করে তুলেছে।
একজন পশু চিকিৎসক জানান, “যারা কুকুরদের রাস্তায় দেখতে চান না, তারা এখন আরও উৎসাহী হয়ে অভিযোগ করছেন। এর ফলে নিয়মিত যারা কুকুরদের খাবার দেন, তারা ভয় পাচ্ছেন।”
তিনি আরও বলেন, “অনেকে এখন খাবার দেওয়া বন্ধ করে দিয়েছেন, কারণ হুমকি দেওয়া হচ্ছে যে তাদের বিরুদ্ধে রিপোর্ট করা হবে। ফলে কুকুরগুলো আরও ক্ষুধার্ত হয়ে উঠছে, যা তাদের আচরণকে আক্রমণাত্মক করে তুলছে।”
এদিকে স্থানীয় এক বয়স্কা নারী জানিয়েছেন, তিনি দুইবার কুকুরের কামড়ে আহত হয়েছেন। তাঁর মতে, “কুকুরগুলোকে হত্যা করা ঠিক নয়, তবে পর্যাপ্ত আশ্রয়কেন্দ্র গড়ে তুলতে হবে যাতে তারা নিরাপদে থাকতে পারে।”
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্য অনুযায়ী, বিশ্বের মোট জলাতঙ্কে মৃত্যুর প্রায় এক-তৃতীয়াংশই ঘটে ভারতে। প্রতিবছর দেশটিতে ১৮ থেকে ২০ হাজার মানুষ এই রোগে মারা যান, যার মধ্যে ৬০ শতাংশই ১৫ বছরের নিচের শিশু। অনেক ক্ষেত্রেই কামড়ের ঘটনা রিপোর্ট করা হয় না বা চিকিৎসা নেওয়া হয় না।
বর্তমানে দিল্লির আশেপাশের আশ্রয়কেন্দ্রগুলোতে শতাধিক কুকুরের পাশাপাশি কয়েকটি বিড়াল ও বানরও রাখা হয়েছে। কেউ রাস্তায় ফেলে দেওয়া, কেউ আক্রমণাত্মক আচরণের কারণে, আবার কেউ অসুস্থ হয়ে পড়ায় এখানে এসেছে।
শহরের রাস্তায় কুকুরদের সাধারণ আচরণ হলো সূর্যের তাপে গা গরম করা, খাবারের খোঁজে ময়লার স্তূপে ঘোরা বা রাতে পাহারার কাজ করা। তারা অনেক সময় দুষ্কৃতিকারী বা বন্য বানর তাড়িয়ে শহরকে সুরক্ষিত রাখে।
একজন স্বেচ্ছাসেবক বলেন, “আমাদের মতো মানুষের ঘর যেমন আছে, কুকুরদের ঘর হলো এই রাস্তা। ওরা আমাদের সন্তানের মতো—যাই হোক না কেন, ওদের পরিত্যাগ করা যায় না।”
কিন্তু আদালতের নির্দেশের পর থেকে যেসব মানুষ কুকুরদের নিয়মিত খাওয়াতেন, তারা এখন ভয়ভীতিতে আছেন। অনেকেই রাতের শেষ প্রহরে লুকিয়ে খাবার দেন যাতে কেউ দেখতে না পায়।
অন্যদিকে, কিছু জায়গায় স্থানীয়দের হাতে কুকুর নির্যাতনের ঘটনাও বেড়েছে। প্রাণী অধিকারকর্মীরা জানাচ্ছেন, নির্যাতনের ফলে কুকুরগুলো আরও আক্রমণাত্মক হয়ে উঠছে। তাদের মতে, “যখন খাবার বা আশ্রয় থাকে না, তখনই তারা কামড়ায় বা রেগে যায়।”
সর্বশেষ আদালতের নির্দেশে বলা হয়েছে—যেসব কুকুর জলাতঙ্কে আক্রান্ত বা চরম আক্রমণাত্মক, শুধুমাত্র তাদেরই আশ্রয়কেন্দ্রে রাখা হবে। অন্যদের টিকাদান, নির্বীজকরণ ও কৃমিনাশক প্রয়োগ শেষে মুক্ত রাখা হবে।
কিন্তু বাস্তবে এই দায়িত্ব এখন পড়েছে সাধারণ নাগরিকদের ওপর। শহরের বিভিন্ন পাড়ায় একেকজন স্বেচ্ছাসেবী ৫–৬টি কুকুরের দায়িত্ব নিয়েছেন। টিকাদানকালে কেউ বাঁশি বাজিয়ে, কেউ ডাক দিয়ে কুকুরদের কাছে টানেন। অনেক সময় কুকুর ভয় পেয়ে গাড়ির নিচে লুকিয়ে পড়ে, আবার তাদের “অভিভাবক”রা দুধ দিয়ে বা ভালোবেসে ডেকে আনেন।
এভাবেই চলছে দিল্লির পথের কুকুরদের জীবনযুদ্ধ—মানুষের ভীতি, ভালোবাসা ও আদালতের সিদ্ধান্তের মধ্যে।



