রাজধানী ঢাকার বাতাসে পাওয়া গেছে এমন এক ক্ষতিকর উপাদান, যা মানুষের শ্বাসতন্ত্র ও ফুসফুসের জন্য মারাত্মক হুমকি সৃষ্টি করছে। ‘রেসপিরেবল সিলিকা’ (আরএস) নামে পরিচিত এই অতিক্ষুদ্র ধূলিকণার পরিমাণ রাজধানীর বাতাসে স্বাভাবিক মাত্রার চেয়ে অনেক বেশি। বিশেষ করে শুষ্ক মৌসুমে, অর্থাৎ নভেম্বর থেকে মার্চ পর্যন্ত সময়ে এর উপস্থিতি দ্বিগুণেরও বেশি হয়ে থাকে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন বিভাগের একটি সাম্প্রতিক গবেষণায় এ তথ্য উঠে এসেছে। বায়ুদূষণের নানা উপাদান নিয়ে আগে একাধিক গবেষণা হলেও, বাতাসে রেসপিরেবল সিলিকার উপস্থিতি নিয়ে এই প্রথম বিস্তারিত গবেষণা করা হলো। গবেষণাটি আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত একটি বৈজ্ঞানিক সাময়িকীতে প্রকাশিত হয়েছে। এতে শুধু এই উপাদানের উপস্থিতিই নয়, বরং তা কীভাবে ফুসফুসের ক্যানসারসহ অন্যান্য রোগ সৃষ্টি করতে পারে, তার বিশ্লেষণও করা হয়েছে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, রেসপিরেবল সিলিকা দীর্ঘমেয়াদে শ্বাসতন্ত্রের রোগ, কিডনি সমস্যা, ফুসফুসের কার্যক্ষমতা হ্রাস এবং ‘সিলিকোসিস’ নামের গুরুতর রোগের কারণ হতে পারে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সংজ্ঞা অনুযায়ী, এই ধূলিকণার আকার ১০ মাইক্রোমিটারের কম—যা সহজেই নাক ও মুখ দিয়ে শরীরে প্রবেশ করে ফুসফুসের গভীরে পৌঁছায়। এত ক্ষুদ্র হওয়ায় এটি বাতাসে অনেকক্ষণ ভেসে থাকতে পারে, ফলে মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ার সম্ভাবনাও বেশি।
গবেষণার পটভূমি ও স্থান:
গবেষণাটি পরিচালনা করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন বিভাগের একজন অধ্যাপক। তিনি জানান, ঢাকায় দ্রুত নগরায়ণ ও অব্যবস্থাপনা বায়ুদূষণকে ভয়াবহ মাত্রায় নিয়ে গেছে। এই অবস্থায় বছরের বিভিন্ন ঋতুতে বাতাসে রেসপিরেবল সিলিকার ঘনত্ব পরিমাপই ছিল গবেষণার মূল উদ্দেশ্য। পাশাপাশি, এই উপাদানের সংস্পর্শে আসার ফলে জনস্বাস্থ্যের ওপর কী ধরনের প্রভাব পড়ছে, তা মূল্যায়ন করা হয়।
২০২৩ সালের নভেম্বর থেকে ২০২৪ সালের এপ্রিল পর্যন্ত এই গবেষণা চলে। ঢাকার পাঁচটি ভিন্ন এলাকা থেকে নমুনা সংগ্রহ করা হয়—ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মুকাররম হোসেন বিজ্ঞান ভবন, গ্রিন মডেল টাউন, টিএসসি এলাকা, ঢাকা মেডিকেল কলেজ এলাকা এবং মেরাদিয়া কাঁচাবাজার।
এই স্থানগুলো বেছে নেওয়ার কারণও ছিল ভিন্ন। মুকাররম হোসেন ভবন একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এলাকা, যেখানে নির্মাণ বা শিল্প কার্যক্রম সীমিত। গ্রিন মডেল টাউন দ্রুত গড়ে ওঠা আবাসিক এলাকা, যেখানে নিয়মিত নির্মাণকাজ হয়। টিএসসি এলাকায় গবেষণার সময় চলছিল মেট্রোরেলের কাজ। ঢাকা মেডিকেল এলাকার বর্জ্য পোড়ানোর কার্যক্রম ও হাসপাতাল সংশ্লিষ্ট কাজও বায়ুদূষণে ভূমিকা রাখে। অন্যদিকে মেরাদিয়া একটি ঘনবসতিপূর্ণ বাজার এলাকা, যেখানে যানবাহন ও মানুষের চলাচল অত্যধিক।
ফলাফল ও সহনীয় মাত্রা:
বাংলাদেশে এখনো আরএসের কোনো ‘সহনীয় মাত্রা’ নির্ধারণ করা হয়নি। তবে যুক্তরাষ্ট্রের পরিবেশ স্বাস্থ্য সংস্থা এই মাত্রা নির্ধারণ করেছে প্রতি ঘনমিটারে ৩ মাইক্রোগ্রাম। গবেষণায় দেখা যায়, ঢাকার মুকাররম হোসেন ভবনে আরএসের পরিমাণ ছিল ১.০৮ মাইক্রোগ্রাম, গ্রিন মডেল টাউনে ২.১৪, ঢাকা মেডিকেল এলাকায় ১.৬৬, টিএসসি এলাকায় ৭.৩৩ এবং মেরাদিয়ায় ৩.৪৫ মাইক্রোগ্রাম। অর্থাৎ, টিএসসি ও মেরাদিয়া এলাকায় ক্ষতিকর ধূলিকণার মাত্রা সবচেয়ে বেশি।
গবেষণায় আরও দেখা গেছে, এই ধূলিকণা ক্যানসার ছাড়াও বিভিন্ন রোগের ঝুঁকি বাড়ায়। ঝুঁকির মাত্রা একের কাছাকাছি হলে তা উচ্চ ঝুঁকি হিসেবে গণ্য হয়। টিএসসি এলাকায় ক্যানসার-সম্পর্কিত নয় এমন রোগের ঝুঁকি ২.৩৭ থেকে ২.৪৮ পর্যন্ত, আর ক্যানসারের ঝুঁকি ২.৭০ থেকে ২.৮৩ পর্যন্ত। মেরাদিয়ায় অন্য রোগের ঝুঁকি ছিল ০.৯৭ থেকে ১.৪০ এবং ক্যানসারের ঝুঁকি ১.১১ থেকে ১.৫৯।
স্বাস্থ্যঝুঁকি ও চিকিৎসকদের মতামত:
চিকিৎসকদের মতে, রেসপিরেবল সিলিকা নাক দিয়ে শরীরে প্রবেশ করে সরাসরি ফুসফুসে পৌঁছায়। এটি শ্বাসপ্রশ্বাসে বাধা সৃষ্টি করে এবং দীর্ঘ মেয়াদে সিলিকোসিস, ফুসফুসের ক্যানসার ও অন্যান্য শ্বাসযন্ত্রের রোগের কারণ হয়। বিশেষজ্ঞদের মতে, সিলিকোসিস এমন একটি রোগ, যা দীর্ঘ সময় ধরে এই ধূলিকণার সংস্পর্শে থাকলে হয় এবং যার স্থায়ী চিকিৎসা নেই।
সরকারের পদক্ষেপ:
নির্মাণকাজ, রাস্তার ধুলাবালি, বর্জ্য পোড়ানো এবং উন্মুক্ত মাটি থেকে এই ধূলিকণা তৈরি হয়। রাজধানীর অধিকাংশ নির্মাণকাজ উন্মুক্ত অবস্থায় পরিচালিত হওয়ায় বাতাসে ধূলিকণার পরিমাণ বাড়ছে। পরিবেশ অধিদপ্তরের এক পরিচালক জানিয়েছেন, সরকার ইতিমধ্যে ‘জিরো সয়েল ক্যাম্পেইন’ শুরু করেছে, যার মাধ্যমে নগরের উন্মুক্ত স্থান ঘাস বা গাছ দিয়ে আচ্ছাদিত করার পরিকল্পনা রয়েছে। তবে নির্মাণকাজের পরিমাণ এত বেশি যে, এটি নিয়ন্ত্রণ করা এখনো বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে আছে।
এই গবেষণার ফলাফল ইঙ্গিত দেয়—ঢাকার মানুষ এমন এক নীরব ঝুঁকির মধ্যে বাস করছে, যা চোখে দেখা যায় না, কিন্তু ফুসফুসের গভীরে পৌঁছে ধীরে ধীরে ক্ষতি করছে।



