আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে জেলা প্রশাসক (ডিসি) নিয়োগে সরকারের অবস্থান নিয়ে প্রশাসনের ভেতরে চলছে নানা আলোচনা। পূর্বে ঘোষণা দেওয়া হয়েছিল—বিগত তিনটি জাতীয় নির্বাচনে দায়িত্ব পালনকারী কোনো কর্মকর্তা এবার নির্বাচনী দায়িত্বে থাকবেন না। তবে সর্বশেষ নিয়োগে দেখা গেছে, সেই ঘোষণার পুরোপুরি প্রতিফলন ঘটেনি।
সম্প্রতি সরকার নতুন করে ২৯ জেলায় জেলা প্রশাসক নিয়োগ দিয়েছে। এর মধ্যে ২১ জন একেবারে নতুন মুখ, আর বাকি আটজনের ক্ষেত্রে শুধু জেলার পরিবর্তন হয়েছে। কিন্তু নিয়োগপ্রাপ্তদের মধ্যে অন্তত দুজন কর্মকর্তা রয়েছেন, যারা অতীত নির্বাচনে সহকারী রিটার্নিং অফিসার হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছিলেন। এতে সরকারের পূর্ব প্রতিশ্রুতি প্রশ্নের মুখে পড়েছে।
এ ছাড়া আরও দুজন কর্মকর্তাকে প্রমোশন দিয়ে ডিসি পদে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে, যাদের প্রশাসনিক অভিজ্ঞতা এখনো পূর্ণ দুই বছর হয়নি। অথচ জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের ২০২২ সালের পদায়ন নীতিমালায় স্পষ্ট বলা আছে—কোনো কর্মকর্তা ডিসি হতে হলে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও), অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (এডিসি) অথবা স্থানীয় সরকারের উপপরিচালক পদে ন্যূনতম দুই বছরের অভিজ্ঞতা থাকতে হবে। এই নিয়মের ব্যত্যয় ঘটায় প্রশাসনের অভ্যন্তরে সমালোচনা দেখা দিয়েছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, সরকার মূলত একটি কঠিন পরিস্থিতিতে পড়েছিল। পূর্বের তিনটি নির্বাচনে যারা দায়িত্বে ছিলেন, তাদের সবাইকে বাদ দিলে যোগ্য কর্মকর্তার সংখ্যা উল্লেখযোগ্যভাবে কমে যাচ্ছিল। ফলে যোগ্যতা ও অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে কর্মকর্তাদের বাছাই করা কঠিন হয়ে পড়েছিল।
একাধিক প্রশাসনিক কর্মকর্তা মনে করছেন, অতীতের তিনটি নির্বাচনে যুক্ত কর্মকর্তাদের বাদ দেওয়ার সিদ্ধান্তটি বাস্তবসম্মত ছিল না। কারণ, প্রশাসনের বড় অংশই কোনো না কোনোভাবে আগের নির্বাচনী দায়িত্বে যুক্ত ছিলেন। ফলে পুরোপুরি নতুন কর্মকর্তাদের দিয়ে মাঠ প্রশাসন সাজানো প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়েছে।
জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের নথি পর্যালোচনায় দেখা যায়, সম্প্রতি নিয়োগপ্রাপ্ত দুই কর্মকর্তার একজন ২০১৪ সালের, অন্যজন ২০১৮ সালের নির্বাচনে সহকারী রিটার্নিং কর্মকর্তার দায়িত্ব পালন করেছিলেন। এই নিয়োগকে কেন্দ্র করে প্রশাসনের ভেতরে প্রশ্ন উঠেছে—যদি নীতিগতভাবে আগের কর্মকর্তাদের বাদ দেওয়া হয়, তবে ব্যতিক্রম কেন থাকবে?
এ ছাড়া আরও দুজন কর্মকর্তাকে প্রমার্জিতভাবে ডিসি করা হয়েছে, যদিও তাদের ইউএনও বা এডিসি পদে অভিজ্ঞতা দুই বছরের কম। এই ব্যতিক্রম নিয়েও জনপ্রশাসনের মধ্যে অসন্তোষ রয়েছে।
অন্যদিকে প্রশাসন ক্যাডারের সঙ্গে একীভূত হওয়া সাবেক ইকোনমিক ক্যাডারের তিনজন কর্মকর্তাকে ডিসি পদে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। যদিও তাদের মাঠ প্রশাসনে—যেমন সহকারী কমিশনার বা ভূমি অফিসের দায়িত্বে—কাজের অভিজ্ঞতা ছিল না। তবুও তারা সরাসরি ডিসি পদে নিয়োগ পেয়েছেন, যা অনেক কর্মকর্তার কাছে প্রশ্নবিদ্ধ বলে মনে হচ্ছে।
অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টারা আগেই জানিয়েছিলেন, মাঠ প্রশাসনে এমন কাউকে দায়িত্ব দেওয়া হবে না, যিনি পূর্ববর্তী তিনটি নির্বাচনে যুক্ত ছিলেন বা নির্বাচনী দায়িত্বে কোনো ভূমিকা রেখেছিলেন। এমনকি স্বরাষ্ট্র ও নির্বাচন কমিশনের পক্ষ থেকেও একই বার্তা দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু বাস্তব চিত্রে দেখা যাচ্ছে, সেই ঘোষণায় শিথিলতা এসেছে।
প্রশাসনের কর্মকর্তারা বলছেন, নির্বাচনের আগে আরও পাঁচ থেকে আট জেলায় নতুন ডিসি নিয়োগ হতে পারে। অনেক কর্মকর্তা নীতিমালা কিছুটা শিথিল করার পক্ষে মত দিয়েছেন, যাতে যোগ্য ও অভিজ্ঞ কর্মকর্তাদের নিয়োগে জটিলতা না দেখা দেয়।
সব মিলিয়ে বলা যায়, ডিসি নিয়োগের ক্ষেত্রে সরকারের কঠোর অবস্থান ধীরে ধীরে নরম হয়েছে। এতে প্রশাসনের অভ্যন্তরে প্রশ্ন উঠেছে—নীতিমালা কি কেবল নথিতেই সীমাবদ্ধ থাকবে, নাকি বাস্তবায়নেও প্রতিফলিত হবে?



