গাজা উপত্যকায় চলমান যুদ্ধ থামাতে নতুন করে ২০ দফার একটি ‘শান্তি পরিকল্পনা’ সামনে আনা হয়েছে। এই পরিকল্পনাকে অনেকে ‘ঐতিহাসিক’ বলে উল্লেখ করলেও বাস্তবে এতে অনেক অস্পষ্টতা রয়ে গেছে। ফলে প্রশ্ন উঠছে, এটি আসলেই কোনো টেকসই শান্তির পথ দেখাবে, নাকি আরও একটি অনিশ্চয়তার অধ্যায় তৈরি করবে।
হোয়াইট হাউসে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে পরিকল্পনাটি ঘোষণা করা হয়। অনুষ্ঠানে ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রীও উপস্থিত ছিলেন এবং তিনি পরিকল্পনার প্রতি সমর্থন জানান। তবে এই প্রস্তাব বাস্তবায়ন কতটা সম্ভব, সেই প্রশ্ন থেকেই যাচ্ছে। বিশেষ করে পরিকল্পনার বিস্তারিত ও প্রয়োগ প্রক্রিয়া স্পষ্ট করে না বলায় অনিশ্চয়তা আরও বেড়েছে।
গাজা পরিচালনা কেমন হবে
পরিকল্পনা অনুযায়ী, গাজা উপত্যকা পরিচালনার জন্য একটি ‘অস্থায়ী অন্তর্বর্তী প্রশাসন’ গঠন করা হবে। এ প্রশাসনের অধীনে থাকবে একটি বেসামরিক ও অরাজনৈতিক ফিলিস্তিনি কমিটি, যারা গাজার দৈনন্দিন বিষয় তদারকি করবে। কিন্তু এই কমিটি কীভাবে গঠিত হবে, সদস্যরা কারা হবেন কিংবা নির্বাচনের নিয়ম কী হবে—এসব তথ্য স্পষ্ট করা হয়নি।
এ ছাড়া পরিকল্পনায় বলা হয়েছে, পুরো বিষয়টি তদারকির জন্য একটি বিশেষ ‘শান্তি বোর্ড’ থাকবে। এর নেতৃত্বে থাকবেন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট এবং যুক্তরাজ্যের সাবেক প্রধানমন্ত্রী। তবে এই বোর্ড ও ফিলিস্তিনি কমিটির মধ্যে সম্পর্ক কেমন হবে কিংবা নিত্যদিনের সিদ্ধান্ত কীভাবে নেওয়া হবে, তা–ও অনির্দিষ্ট রাখা হয়েছে।
ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষের ভূমিকা
পরিকল্পনায় উল্লেখ করা হয়েছে, ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষ (পিএ) নিজেদের অভ্যন্তরীণ সংস্কার শেষ করে সক্ষমতা অর্জন না করা পর্যন্ত গাজার নিয়ন্ত্রণ থাকবে অস্থায়ী প্রশাসনের হাতে। কিন্তু এই সক্ষমতা অর্জন কবে নাগাদ হবে, কে তা যাচাই করবে কিংবা কোন মানদণ্ড পূরণ করতে হবে—এসবের কোনো নির্দেশনা দেওয়া হয়নি। সময়সীমার কথাও পরিকল্পনায় উল্লেখ নেই।
অন্যদিকে গাজা উপত্যকাকে মূলত একটি আলাদা সত্তা হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে, যা পরবর্তীতে অধিকৃত ফিলিস্তিনি ভূখণ্ডের সঙ্গে যুক্ত হওয়ার প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। যদিও ইসরায়েলের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, গাজার শাসন ক্ষমতা হামাস কিংবা ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষের হাতে দেওয়া হবে না।
আন্তর্জাতিক বাহিনী নিয়ে ধোঁয়াশা
শান্তি পরিকল্পনায় আরও বলা হয়েছে, গাজায় নিরাপত্তা রক্ষায় একটি ‘অস্থায়ী আন্তর্জাতিক স্থিতিশীলতা বাহিনী’ কাজ করবে। তবে কোন কোন দেশ এ বাহিনীতে যোগ দেবে, বাহিনীর ক্ষমতা কতটুকু হবে কিংবা তাঁদের কার্যক্রম কেমন হবে—এসব বিষয়ে কোনো স্পষ্ট ধারণা দেওয়া হয়নি।
তাঁরা কি সেনাবাহিনী হিসেবে দায়িত্ব পালন করবেন, নাকি পুলিশের মতো কাজ করবেন, নাকি শুধুই পর্যবেক্ষকের ভূমিকায় থাকবেন—এমন প্রশ্নও অনুত্তরিত রয়ে গেছে। এমনকি হামাসের বিরুদ্ধে তাঁদের সরাসরি নামানো হবে কিনা, অথবা ইসরায়েলি বাহিনীর সঙ্গে ফিলিস্তিনিদের রক্ষায় একত্রে কাজ করবে কিনা, সেটিও উল্লেখ করা হয়নি।
ইসরায়েলি সেনা প্রত্যাহার
পরিকল্পনায় বলা হয়েছে, ইসরায়েলি সেনারা গাজা থেকে কবে প্রত্যাহার হবে, তা নির্ভর করবে নিরস্ত্রীকরণের মান ও সময়সীমার ওপর। কিন্তু এর কোনো নির্দিষ্ট তারিখ দেওয়া হয়নি। আরও বলা হয়েছে, গাজায় যেকোনো সম্ভাব্য ‘সন্ত্রাসী হুমকি’ না কমা পর্যন্ত ইসরায়েল নিরাপত্তা নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখবে। তবে এই শর্তপূরণের মানদণ্ড কে নির্ধারণ করবে বা কখন তা পূর্ণ হবে, সে বিষয়ে কোনো পরিষ্কার নির্দেশনা নেই।
ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের ভবিষ্যৎ
প্রস্তাবে ফিলিস্তিনি রাষ্ট্র গঠনের প্রসঙ্গও অস্পষ্টভাবে এসেছে। বলা হয়েছে, গাজার উন্নয়ন ও পিএর সংস্কার কার্যক্রম শেষে হয়তো একটি নতুন আলোচনা শুরু হতে পারে। তবে তা নিশ্চিত নয়। বরং প্রস্তাবে সরাসরি ফিলিস্তিনি রাষ্ট্রের অধিকার স্বীকৃতি দেওয়া হয়নি। শুধু উল্লেখ করা হয়েছে—যা ফিলিস্তিনিরা চাইছেন, তা নিয়ে ভবিষ্যতে আলোচনা হতে পারে।
এভাবে গোটা পরিকল্পনায় অনেক দিকই অনির্দিষ্ট ও অস্পষ্ট রাখা হয়েছে। ফলে গাজা উপত্যকা ও পুরো অঞ্চলের ভবিষ্যৎ নিয়ে প্রশ্ন থেকে যাচ্ছে। শান্তির নামে এই প্রস্তাব কার্যত আরও নতুন সংকটের জন্ম দেবে কিনা—তা নিয়েই এখন বিতর্ক শুরু হয়েছে।