টোকিওতে অনুষ্ঠিত সাম্প্রতিক বৈঠকে যুক্তরাষ্ট্র ও জাপানের দুই শীর্ষ নেতার বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক নতুন করে আলোচনায় এসেছে। আনুষ্ঠানিক কূটনৈতিক পরিসর ছাড়িয়ে তাদের পারস্পরিক আচরণ যেন পুরোনো বন্ধুদের মতো ছিল—হাসি, করমর্দন, কাঁধে চাপড় ও পরস্পরের প্রতি শ্রদ্ধায় ভরা এক আন্তরিক মুহূর্ত।
বৈঠকের শুরুতে এক হালকা রসিকতা ছিল, যা ঘিরে ছিল জনপ্রিয় বেসবল টিমের খেলার প্রসঙ্গ। এর পরেই মার্কিন প্রেসিডেন্ট তাঁর এশিয়া সফরের দ্বিতীয় নোবেল শান্তি পুরস্কার মনোনয়ন পান এবং জাপানের প্রয়াত সাবেক প্রধানমন্ত্রী কর্তৃক ব্যবহৃত একটি গলফ পাটার উপহার হিসেবে গ্রহণ করেন—যিনি অতীতে মার্কিন নেতার ঘনিষ্ঠ বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কের প্রতীক ছিলেন।
এরপর ইয়োকোসুকা নৌঘাঁটিতে আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে দুই নেতা একসঙ্গে মঞ্চে ওঠেন। সেখানে মার্কিন প্রেসিডেন্ট প্রকাশ্যে জাপানি প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বের প্রশংসা করেন। জাপানি নেতা এক হাত উঁচু করে দৃঢ় ভঙ্গিতে সাড়া দেন—যা মুহূর্তের মধ্যেই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল হয়ে পড়ে। এই দৃশ্য অনেকের কাছেই ইঙ্গিত দেয় যে, পুরনো মিত্রতার যুগ আবার ফিরে এসেছে।
এক মার্কিন ব্যবসায়ী ফোরামে বক্তৃতাকালে প্রেসিডেন্ট বলেন, “তাঁর সঙ্গে অল্প সময়েই ভালোভাবে পরিচিত হতে পেরেছি। তিনি অত্যন্ত মনোমুগ্ধকর ব্যক্তিত্ব।”
এতটা উষ্ণ সম্পর্ক সাধারণত দেখা যায় না, বিশেষ করে এমন দুই নেতার মধ্যে, যাদের দেশের মধ্যে পূর্বে শুল্কনীতি নিয়ে নানা বিরোধ ছিল। একইভাবে জাপানি প্রধানমন্ত্রীকেও আন্তর্জাতিক অঙ্গনে এত খোলামেলা বন্ধুত্ব প্রকাশ করতে খুব একটা দেখা যায়নি।
দুজনই রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গিতে প্রায় একই পথে হাঁটেন। উভয়েই রক্ষণশীল নীতির অনুসারী এবং প্রতিরক্ষা শক্তি বৃদ্ধির পক্ষে অবস্থান নেন। বিশেষ করে চীনের প্রতি কঠোর মনোভাব—দুই দেশের সম্পর্কের একটি সাধারণ সূত্র। প্রয়াত জাপানি নেতার সঙ্গে উভয়ের ঘনিষ্ঠ সম্পর্কও বর্তমান বন্ধুত্বের পেছনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।
এই বন্ধুত্বপূর্ণ পরিবেশের আড়ালেই রয়েছে এক কৌশলগত মিত্রতা—যেখানে উভয় পক্ষের লক্ষ্য এক: এশিয়া-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে শক্ত অবস্থান নিশ্চিত করা। চীনের প্রতি কঠোর অবস্থান গ্রহণের মাধ্যমে মার্কিন প্রশাসন যেমন কূটনৈতিক সুবিধা পাচ্ছে, তেমনি জাপানের প্রধানমন্ত্রীও দেশীয় রাজনীতিতে নিজের অবস্থানকে শক্তিশালী করতে পারছেন।
বৈঠকে উভয় নেতা বিরল খনিজ সম্পদে চীনের আধিপত্য কমাতে একটি নতুন কাঠামোর ঘোষণা দেন। এর লক্ষ্য হলো গুরুত্বপূর্ণ উপকরণে বিকল্প উৎস নিশ্চিত করা, যাতে ২০১০ সালের মতো ‘রেয়ার আর্থ সংকট’ আর না ঘটে। জাপান দীর্ঘদিন ধরে স্থিতিশীল সরবরাহব্যবস্থা গড়ে তোলার ওপর জোর দিচ্ছে।
বাণিজ্য ও বিনিয়োগও আলোচনার অন্যতম বড় বিষয় ছিল। জাপান প্রায় ৪৯০ বিলিয়ন ডলারের বিনিয়োগের প্রতিশ্রুতি দিয়েছে, যার মূল ক্ষেত্র কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, সেমিকন্ডাক্টর, প্রতিরক্ষা ও উন্নত উৎপাদনশিল্প। এই বিনিয়োগ দুই দেশের মধ্যে সেপ্টেম্বর মাসে স্বাক্ষরিত বৃহত্তর বাণিজ্যচুক্তিরই অংশ।
প্রেসিডেন্টের প্রথম মেয়াদকাল থেকেই দুই দেশের সম্পর্ক ঘনিষ্ঠ হয়ে উঠেছিল। সেই সময় বিশ্ব অঙ্গনে অনেকেই তাঁর নেতৃত্ব নিয়ে প্রশ্ন তুললেও জাপান দৃঢ়ভাবে পাশে ছিল। পূর্ববর্তী জাপানি নেতার কূটনৈতিক দক্ষতা এবং বন্ধুত্বপূর্ণ উদ্যোগ দুই দেশের সম্পর্কে নতুন মাত্রা এনে দেয়।
প্রয়াত নেতার পরিবারের সঙ্গে মার্কিন প্রেসিডেন্টের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক এখনও বজায় আছে। সেই বন্ধুত্বের ঐতিহ্যই যেন নতুন নেতৃত্বের হাত ধরে আরও দৃঢ় হচ্ছে।
বিশ্লেষকদের মতে, জাপানি প্রধানমন্ত্রীর জন্য এটি রাজনৈতিকভাবে বড় একটি সাফল্য, যা তাঁর জনপ্রিয়তা আরও বাড়াতে সাহায্য করবে। অন্যদিকে, মার্কিন প্রেসিডেন্টও এই সম্পর্কের মাধ্যমে চীনের সঙ্গে আসন্ন বৈঠকে কূটনৈতিক অবস্থান শক্ত করতে পারবেন।
সবশেষে বলা যায়, টোকিওর এই বৈঠক শুধু হাসি ও করমর্দনের নয়, বরং দুই পরাশক্তির মধ্যকার কৌশলগত সহযোগিতার নতুন অধ্যায় রচনা করেছে।



