Thursday, November 20, 2025
spot_img
Homeঅন্যান্যছেলেকে খুঁজে ফেরার স্বপ্ন: এখন শুধু কবর দেওয়ার আশায় এক মা

ছেলেকে খুঁজে ফেরার স্বপ্ন: এখন শুধু কবর দেওয়ার আশায় এক মা

গাজার দক্ষিণাঞ্চলের খান ইউনিসের একটি হাসপাতালের ছোট্ট একটি কক্ষে নিস্তব্ধতা। চারপাশে সাদা দেয়াল, সামনে বসে আছেন ডজনখানেক নারী— কেউ মা, কেউ বোন, কেউবা স্ত্রী। চোখ স্থির এক স্ক্রিনের দিকে, যেখানে ভেসে উঠছে পচে যাওয়া দেহাবশেষের ছবি। কেউ নিশ্চুপে কাঁদছেন, কেউ আবার নিঃশব্দে তাকিয়ে আছেন। প্রত্যেকেই খুঁজছেন কোনো এক প্রিয় মুখ, কোনো পরিচিত চিহ্ন— হয়তো একসময় তাঁদের প্রিয়জন ছিল।

গাজার স্থানীয় কর্তৃপক্ষের আহ্বানে পরিবারগুলো এসেছে এখানে। তাঁদের আশা, এই ছবিগুলোর মধ্যে হয়তো মিলবে সেই নিখোঁজ সন্তানের বা স্বামীর চিহ্ন। সম্প্রতি ইসরায়েলি বাহিনী ফিলিস্তিনের স্বাধীনতাকামী সংগঠনের সঙ্গে বন্দী বিনিময়ের অংশ হিসেবে কিছু মরদেহ ফেরত দিয়েছে। তবে এসব মরদেহের অবস্থা এতটাই ভয়াবহ যে সেগুলো শনাক্ত করা প্রায় অসম্ভব। অধিকাংশ দেহেই নির্যাতনের চিহ্ন স্পষ্ট, কারও হাত-পা নেই, কারও আবার চোখ বাঁধা অবস্থায় পাওয়া গেছে।

সবচেয়ে বড় কষ্টের বিষয় হলো, ফেরত দেওয়া এসব মরদেহের কোনো তথ্য দেওয়া হয়নি— না মৃত্যুর স্থান, না তারিখ, এমনকি কোনো শনাক্তকরণ নম্বরও নয়। ফলে গাজায় বসবাসরত পরিবারগুলো বাধ্য হচ্ছে এক ভয়ংকর মানসিক যন্ত্রণার মধ্য দিয়ে যেতে, যেখানে তাদের প্রিয়জনকে খুঁজতে হচ্ছে পচে-গলে বিকৃত হয়ে যাওয়া মৃতদেহের ছবির মধ্যে।

এক মা, বয়স প্রায় পঁয়তাল্লিশ, তাঁর নিখোঁজ ছেলেকে খুঁজছেন সেই ছবিগুলোর মাঝে। ছেলে হারিয়েছেন প্রায় এক বছর আগে। তিনি বলেন, “আমি চুল থেকে শুরু করে জুতো পর্যন্ত প্রতিটি দিক দেখি। কিন্তু কিছুই পাই না। শুধু হতাশা আর চোখের জলই আমার সঙ্গী।”

সেই মা এখন চিকিৎসার জন্য বিদেশে রয়েছেন, কিন্তু মন পড়ে আছে গাজায়— সেই ছেলেটির জন্য, যে একদিন কাঠ ও ত্রিপল খুঁজতে বেরিয়ে আর ফিরে আসেনি। তাঁকে শেষবার দেখা গিয়েছিল এক আত্মীয়ের সঙ্গে, আর তারপর থেকে দুজনেরই কোনো খোঁজ নেই।

তিনি জানান, কেউ কেউ বলেছেন হয়তো ইসরায়েলি বাহিনী রাস্তা সমান করার সময় তাদের হত্যা করে বালিচাপা দিয়েছে। কেউ বলেছেন হয়তো বন্দী করে নিয়ে গেছে। এখনো তিনি আশায় থাকেন, হয়তো কোনো বন্দী তালিকায় ছেলের নাম একদিন দেখতে পাবেন। আবার ভয়ও পান— হয়তো মৃতদের ছবির মধ্যেই ছেলেকে খুঁজে পাবেন।

তার ছেলেটি ছিল শান্ত ও পরিশ্রমী। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার স্বপ্ন ছিল তার। কিন্তু পারিবারিক টানাপোড়েনের কারণে সে ঠিক করেছিল আগে কিছু টাকা জমাবে। সেই স্বপ্ন এখন কেবল মায়ের স্মৃতিতে রয়ে গেছে।

এই মায়ের কথা শুধু তাঁর নয়, গাজার হাজারো পরিবারেরই প্রতিচ্ছবি। সেখানে এখনো প্রায় ১০ হাজার মানুষ নিখোঁজ, যাদের অনেকের দেহ হয়তো ধ্বংসস্তূপের নিচে চাপা পড়ে আছে।

মানবাধিকার সংস্থাগুলোর তথ্য অনুযায়ী, প্রায় আড়াই হাজারেরও বেশি ফিলিস্তিনি এখনো ইসরায়েলের হেফাজতে রয়েছেন, যাদের অবস্থান অজানা। তাদের ভাগ্যে কী ঘটেছে, তা জানে না কেউ।

গাজার স্বাস্থ্যব্যবস্থা প্রায় সম্পূর্ণ ধ্বংস হয়ে গেছে। ডিএনএ পরীক্ষার সরঞ্জাম না থাকায় মরদেহ শনাক্ত করা প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়েছে। নতুন যন্ত্রপাতি আনতেও বাধা দিচ্ছে অবরোধ। ফলে পরিবারের সদস্যদের একমাত্র ভরসা বিকৃত মরদেহের ছবি দেখা— এক ভয়ংকর বাস্তবতা।

ওই মা বলেন, “আমি শুধু আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করি, অন্তত যেন তাকে কবর দিতে পারি। জীবিত অবস্থায় তাকে বুকে জড়িয়ে ধরার স্বপ্নটা ভেঙে গেছে, এখন শুধু চাই— অন্তত তাকে নিজের হাতে মাটিতে শুইয়ে দিতে।”

গাজার এই যুদ্ধ শুধু প্রাণ কেড়ে নেয়নি, কেড়ে নিয়েছে পরিচয়, স্মৃতি ও শান্তির প্রতিটি চিহ্ন। আর সেই ধ্বংসস্তূপের নিচে এখনো শুয়ে আছে হাজারো অসমাপ্ত স্বপ্ন— এক মায়ের বুকভরা আর্তনাদের মতো।

RELATED ARTICLES

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

- Advertisment -
Google search engine

Most Popular

Recent Comments