চীন ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে দীর্ঘদিন ধরে চলা বাণিজ্যিক উত্তেজনা কিছুটা প্রশমিত হলেও মূল সমস্যা এখনো অমীমাংসিত রয়ে গেছে। সম্প্রতি দক্ষিণ কোরিয়ায় দুই দেশের নেতাদের বৈঠকের পর নতুন করে আশার সঞ্চার হলেও, বিশেষজ্ঞদের মতে এটি কোনো স্থায়ী সমাধান নয়—বরং এটি কেবল একটি প্রয়োজনীয় ‘বিরতি’।
বৈঠকের পর উভয় পক্ষের মন্তব্যে স্পষ্ট বৈপরীত্য দেখা যায়। যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রপ্রধান বৈঠককে “অসাধারণ” বলে উল্লেখ করে ১২ এর মধ্যে ১০-এর বেশি নম্বর দেন। অপরদিকে, চীনের পক্ষ থেকে জানানো হয়—দুই দেশ একটি “সম্মতিতে” পৌঁছেছে এবং দ্রুত পরবর্তী পদক্ষেপ নির্ধারণ করতে হবে।
বাণিজ্যনীতি নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের প্রচলিত কৌশল—কঠোর অবস্থান নেওয়া ও হুমকি প্রদর্শন—চীনের পাল্টা প্রতিক্রিয়ায় এবার তেমন কার্যকর হয়নি। যুক্তরাষ্ট্র একসময় চীনা পণ্যের ওপর ১৪৫% শুল্ক আরোপের ঘোষণা দিয়েছিল, কিন্তু সাম্প্রতিক সমঝোতায় সেই হার কমিয়ে গড়ে ৪৫%-এ নামিয়ে আনা হয়েছে। একই সঙ্গে প্রযুক্তি রপ্তানির ওপর কঠোর নিয়ন্ত্রণ সাময়িকভাবে স্থগিত করা হয়েছে।
অন্যদিকে, চীন জানিয়েছে, তারা যুক্তরাষ্ট্র থেকে সয়াবিন আমদানি করবে এবং গুরুত্বপূর্ণ বিরল ধাতু (rare earth elements) রপ্তানিতে কঠোর নিষেধাজ্ঞা আপাতত স্থগিত রাখবে। তবে, যুক্তরাষ্ট্রের উন্নতমানের এনভিডিয়া ব্ল্যাকওয়েল চিপ চীন পাবে কি না, তা এখনো অনিশ্চিত। বিশেষজ্ঞদের মতে, চীন যদি এই চিপের অ্যাক্সেস পায়, তবে যুক্তরাষ্ট্রের কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (AI) ক্ষেত্রে এগিয়ে থাকার সুবিধা উল্লেখযোগ্যভাবে কমে যেতে পারে, যা অর্থনৈতিক ও নিরাপত্তা—দুই দিক থেকেই প্রভাব ফেলবে।
এই সমঝোতাটি এক বছরের জন্য কার্যকর থাকবে, যা অনেকের মতে কেবলমাত্র একটি ‘বিরতি’। কারণ, যুক্তরাষ্ট্রের বর্তমান প্রশাসনের বাণিজ্যনীতি প্রায়ই অস্থির ও অনিশ্চিত। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্র কানাডার বিরুদ্ধে নতুন করে ১০% শুল্ক আরোপের ঘোষণা দেয়, যা একটি প্রাদেশিক রাজনৈতিক বিজ্ঞাপন নিয়ে অসন্তোষ থেকে উদ্ভূত।
এই পরিস্থিতি মিত্র দেশগুলোকে নতুন বিকল্পের সন্ধান করতে বাধ্য করছে। উদাহরণস্বরূপ, ভারতের ওপর যুক্তরাষ্ট্রের কঠোর শুল্কনীতি দেশটিকে চীনের দিকে আরও ঝুঁকিয়েছে। দীর্ঘমেয়াদে বৈশ্বিক প্রভাব ধরে রাখতে চাইলে যুক্তরাষ্ট্রকে সহযোগিতামূলক অংশীদারিত্ব বাড়াতে হবে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা।
এই সফরে যুক্তরাষ্ট্র কয়েকটি বাণিজ্য চুক্তি সম্পাদন করলেও মৌলিক সমস্যাগুলো থেকে যায়। আজকের দিনে কোনো দেশই নিশ্চিত নয় যে, যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে করা বাণিজ্যিক সম্পর্ক আগামী মাসে কতটা স্থিতিশীল থাকবে। তাছাড়া, যুক্তরাষ্ট্র ক্রমেই আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান ও ফোরাম থেকে নিজেদের গুটিয়ে নিচ্ছে, যেখানে চীন তার প্রভাব বাড়াতে সক্রিয়ভাবে কাজ করছে।
অন্যদিকে, চীন দীর্ঘদিন ধরে অর্থনৈতিক দুর্বলতা মোকাবিলায় কৌশলগত পদক্ষেপ নিচ্ছে। বর্তমান বিরতি তাদের সেই প্রস্তুতি আরও জোরদার করার সুযোগ দেবে। যদিও যুক্তরাষ্ট্র সম্প্রতি অস্ট্রেলিয়ার সঙ্গে গুরুত্বপূর্ণ খনিজ সম্পদ নিয়ে নতুন চুক্তি করেছে, কিন্তু চীনের ওপর নির্ভরতা কমাতে হলে আরও দীর্ঘ পথ পাড়ি দিতে হবে—যেমনটি জাপানের অভিজ্ঞতা দেখিয়েছে।
চীন যে বিরল ধাতুর সরবরাহ নিয়ন্ত্রণকে কৌশলগত অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করতে শুরু করেছে, তা শুধু যুক্তরাষ্ট্র নয়, অন্যান্য দেশকেও উদ্বিগ্ন করেছে। কানাডায় অনুষ্ঠিতব্য জি–৭ সম্মেলনে চীনের প্রভাব মোকাবিলায় নতুন জোট গঠনের আলোচনা হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। একইভাবে ইউরোপীয় ইউনিয়নেরও উচিত হবে চীনা চাপের বিরুদ্ধে সুস্পষ্ট অবস্থান নেওয়া।
এদিকে, যুক্তরাষ্ট্রের ওপর রপ্তানি নির্ভরতা কিছুটা কমলেও, চীনের অর্থনীতিতে ‘ডাম্পিং’ বা অতিরিক্ত পণ্য সরবরাহ নিয়ে অন্য দেশগুলোর উদ্বেগ বাড়ছে। বহু বছর ধরে দেশটি ঘরোয়া ভোক্তা ভিত্তিক অর্থনীতি গঠনের প্রতিশ্রুতি দিলেও, বাস্তবে তাদের মনোযোগ এখনো উচ্চপ্রযুক্তি ও শিল্প স্বনির্ভরতার দিকেই।
দুই দেশের সাম্প্রতিক বৈঠকটি আপাতত উত্তেজনা কমানোর সুযোগ এনে দিয়েছে বটে, কিন্তু গভীরে থাকা দ্বন্দ্ব এখনো অমীমাংসিত। এই অনিশ্চয়তার প্রভাব শুধু যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের ওপর নয়—বিশ্ব অর্থনীতির ওপরও পড়ছে, যেখানে অনেকে আর কোনো পক্ষের প্রতিশ্রুতির ওপর আস্থা রাখতে পারছেন না।



