আফ্রিকার মাটিতে আবারও শুরু হয়েছে দুই পরাশক্তির নীরব প্রতিযোগিতা— যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের। এবার কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে খনিজ সম্পদ। আধুনিক প্রযুক্তি, ইলেকট্রিক যান, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বা অস্ত্র উৎপাদন— সবকিছুর জন্যই প্রয়োজনীয় লিথিয়াম, কোবাল্ট, টাংস্টেন ও রেয়ার আর্থ উপাদানের বিশাল ভাণ্ডার আফ্রিকায়। আর এই সম্পদ ঘিরেই গড়ে উঠছে বৈশ্বিক বিনিয়োগের নতুন অক্ষ।
চীন বহু বছর ধরে বিশ্বের প্রধান খনিজ রপ্তানিকারক ও প্রক্রিয়াজাতকরণে নেতৃত্ব দিয়ে আসছে। আফ্রিকার বিভিন্ন দেশে তাদের বড় বড় খনন প্রকল্প রয়েছে। কিন্তু সর্বশেষ পরিসংখ্যান বলছে, এখন যুক্তরাষ্ট্রই আফ্রিকার সবচেয়ে বড় বৈদেশিক বিনিয়োগকারী দেশ হিসেবে উঠে এসেছে।
সাম্প্রতিক তথ্য অনুযায়ী, ২০২৩ সালে যুক্তরাষ্ট্র আফ্রিকা জুড়ে বিনিয়োগ করেছে প্রায় ৭.৮ বিলিয়ন মার্কিন ডলার, যেখানে চীনের বিনিয়োগ ছিল প্রায় ৪ বিলিয়ন ডলার। ২০১২ সালের পর প্রথমবারের মতো যুক্তরাষ্ট্র এই ক্ষেত্রে চীনকে পেছনে ফেলল।
এই বিনিয়োগ কার্যক্রম পরিচালনা করছে যুক্তরাষ্ট্রের আন্তর্জাতিক উন্নয়ন অর্থায়ন করপোরেশন (DFC)। সংস্থাটি ২০১৯ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়, যার উদ্দেশ্য কৌশলগত অঞ্চলগুলোতে চীনের প্রভাবের মোকাবিলা করা। আফ্রিকায় মার্কিন উপস্থিতি জোরদার করাই এখন তাদের অগ্রাধিকার।
আফ্রিকার দেশগুলোও এই বিনিয়োগে উপকৃত হচ্ছে। উদাহরণস্বরূপ, একটি রুয়ান্ডান খনন সংস্থা সম্প্রতি DFC থেকে প্রায় ৩.৯ মিলিয়ন ডলার সহায়তা পেয়েছে, যা টিন, ট্যানটালাম এবং টাংস্টেন আহরণের জন্য তিনটি খনি উন্নয়নে ব্যয় করা হচ্ছে। সংস্থার চেয়ারম্যান জানান, যুক্তরাষ্ট্র তাদের কার্যক্রমে সরাসরি সহযোগিতা দিচ্ছে এবং এর ফলে রুয়ান্ডার খনিজ এখন যুক্তরাষ্ট্রের পেনসিলভানিয়ার একটি কারখানায় প্রক্রিয়াজাত হচ্ছে।
তিনি আরও বলেন, এই সহযোগিতা বাণিজ্যিকভাবে স্বাধীন সিদ্ধান্তের ফল, সরকারের কোনো বাধ্যবাধকতা নয়। তাদের কোম্পানি সংঘাতমুক্ত, শিশুশ্রমবিহীন এবং পরিবেশবান্ধবভাবে কাজ করছে— যা স্থানীয় জনগণ ও সরকারের জন্যও ইতিবাচক দৃষ্টান্ত তৈরি করছে।
অন্যদিকে, আফ্রিকার অর্থনীতিবিদরা সতর্ক করছেন যে, যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে চুক্তি করার সময় আফ্রিকান দেশগুলোকে তাদের নিজস্ব স্বার্থ রক্ষা করতে হবে। এক অর্থনীতিবিদ মন্তব্য করেছেন, “যুক্তরাষ্ট্রের বিনিয়োগের সঙ্গে আলোচনা করার সময় আফ্রিকান দেশগুলোর নিজেদের প্রস্তুত থাকতে হবে এবং কী চায় তা স্পষ্টভাবে জানা জরুরি।”
তিনি আরও বলেন, আফ্রিকার উচিত কেবল খনিজ রপ্তানির বিনিময়ে অর্থ নেওয়া নয়, বরং যৌথ উদ্যোগ, শেয়ারভিত্তিক অংশগ্রহণ বা প্রোডাকশন শেয়ারিং মডেল অনুসরণ করা— যাতে দেশগুলোর নিজস্ব সম্পদ দিয়ে ভবিষ্যতে শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতে বিনিয়োগ করা সম্ভব হয়।
এছাড়া আফ্রিকাতেই খনিজ প্রক্রিয়াজাতকরণ শিল্প গড়ে তোলার ওপরও জোর দিচ্ছেন বিশেষজ্ঞরা। এতে স্থানীয় কর্মসংস্থান তৈরি হবে এবং অর্থনৈতিক মূল্য বৃদ্ধি পাবে। বর্তমানে একটি মার্কিন প্রতিষ্ঠান দক্ষিণ আফ্রিকার গাউতেং প্রদেশে রেয়ার আর্থ ধাতু প্রক্রিয়াজাতকরণের কারখানা নির্মাণ করছে। প্রতিষ্ঠানটির প্রধান বলেন, “আফ্রিকার সম্পদকে ব্যবহার করে এখানেই প্রক্রিয়াজাতকরণ সম্ভব— এতে দক্ষতা বৃদ্ধি পাবে এবং নতুন শিল্পভিত্তিক অর্থনীতি তৈরি হবে।”
তবে আন্তর্জাতিক বিশ্লেষকরা মনে করছেন, যুক্তরাষ্ট্র কিছু সুযোগ হাতছাড়া করেছে। আগের প্রশাসনের সময়ে আফ্রিকার ওপর আরোপিত বাণিজ্য শুল্ক তাদের আগ্রহ কিছুটা কমিয়েছে। ফলে, চীনের বিনিয়োগে অসন্তুষ্ট আফ্রিকান দেশগুলোকেও পুরোপুরি পাশে টানতে পারেনি যুক্তরাষ্ট্র।
তবু এখন নতুন প্রতিযোগিতা শুরু হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের পাশাপাশি ব্রাজিল, ভারত ও জাপানের মতো দেশও আফ্রিকার সম্পদে বিনিয়োগের আগ্রহ দেখাচ্ছে। আফ্রিকা, তাই এখন বিশ্ব অর্থনীতির পরবর্তী বড় মঞ্চে পরিণত হতে চলেছে— যেখানে খনিজ সম্পদই হতে পারে ক্ষমতার নতুন মাপকাঠি।



