গৃহহীনতা শুধু সামাজিক সংকট নয়, এটি মানবিক ব্যর্থতারও প্রতিচ্ছবি। এই বাস্তবতা সত্যিই বোঝা যায় তখনই, যখন আমরা সরাসরি গৃহহীন মানুষদের কথা শুনি। একজন সাংবাদিক হিসেবে গৃহহীনতা নিয়ে কাজ করার শুরুতে একজন সেবাদানকারী এক গুরুত্বপূর্ণ কথা বলেছিলেন — “একজন গৃহহীনের সঙ্গে দেখা মানে একজন গৃহহীনেরই গল্প জানা, কারণ প্রতিটি গল্পই আলাদা।”
এই কথাটিই লেখকের পথপ্রদর্শক হয়ে ওঠে। তিনি শুধু নীতিমালা বা আবাসন সংক্রান্ত বিতর্ক নয়, বরং রাস্তায়, মহল্লায় কিংবা শহরের কোণায় কোণায় থাকা মানুষদের গল্প জানতে চেয়েছেন।
একদিন তিনি দেখলেন, এক ব্যক্তি তার বাসার সামনে একটি আরভি ভ্যানে থাকছেন, পাশে একটি সাদা কুকুর। মানুষটি পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন, কিন্তু গৃহহীন। অনেক প্রতিবেশী বিরক্ত হলেও লেখক চেয়েছিলেন সবাই যেন তাকে সাহায্য করে। একজন প্রতিবেশী আইনজীবী এমনকি বিনামূল্যে আইনি সহায়তাও দেন। কিছুদিন পর সেই মানুষটি নিজের পথ বেছে নিয়ে চিরতরে সরে যান সেই এলাকা থেকে।
আরেকদিন তিনি এক নারীকে দেখেন একটি মদের দোকানের সামনে বসে থাকতে—পায়ে হাসপাতালের ব্রেসলেট, সদ্য ছাড়পত্র পাওয়া। তার ফোন ভেঙে দিয়েছে প্রাক্তন বাগদত্তা। তিনি শুধু এক রাতের আশ্রয় খুঁজছিলেন। লেখক ২১১ হেল্পলাইন-এ যোগাযোগ করেন, কিন্তু কাছাকাছি কোথাও জায়গা পাওয়া যায়নি। অবশেষে দোকানমালিক এবং কর্মচারীরা সাহায্যের হাত বাড়ান; একজন উবার ড্রাইভারকে টাকা দিয়ে মহিলাকে হাসপাতালে পৌঁছে দেন। পরে সেই নারী ফোনে ধন্যবাদ জানিয়ে জানান, তিনি ভালো আছেন—এরপর আর যোগাযোগ হয়নি।
এখন সেই অঞ্চলের আশ্রয়কেন্দ্রগুলোকে একটি কম্পিউটারাইজড সিস্টেমের মাধ্যমে রিয়েল টাইমে ট্র্যাক করা হয়, যা সাহায্যপ্রার্থীদের দ্রুত সেবা দিতে সহায়ক হচ্ছে।
আরেকজন মানুষ ছিলেন, মধ্যবয়সী, পরিষ্কার পোশাকে প্রতিদিন একটি দোকানের বাইরে বসতেন। একসময় বড় প্রতিষ্ঠানে চাকরি করতেন, কিন্তু চাকরি হারিয়ে, বেকারভাতা শেষ হয়ে গেলে রাস্তায় নামেন। তার একটাই ইচ্ছা ছিল—একটি ঘর ভাড়া করা। অবশেষে এক সংস্থা তাকে একটি বহুতল অ্যাপার্টমেন্টে জায়গা দেয়। লেখক সেখানে গিয়ে তাকে খাবার দেন। কিন্তু বাস্তবতা তার কল্পনার ঘর ছিল না—“এখানকার মানুষ একটু অদ্ভুত,” বলেছিলেন তিনি। এরপর লেখকের সঙ্গে যোগাযোগ হারিয়ে ফেলেন।
আরেকজনের গল্প ভিন্ন। তিনি একসময় আদালতের মামলায় ছোটখাটো অপরাধে দোষী সাব্যস্ত হন। সেই থেকেই লেখকের সঙ্গে যোগাযোগ। জীবনে একাধিকবার কারাভোগ করেছেন, আবার মুক্তিও পেয়েছেন। তিনি চেষ্টা করছিলেন কোনো প্রশিক্ষণ নিয়ে জীবনের নতুন সূচনা করতে, কিন্তু প্রস্তুতির অভাবে ব্যর্থ হন। এখন তার আয়ের উৎস সরকারি ভাতা ও খাদ্য সহায়তা কার্ড। কখনো ট্রেনে, কখনো বাসে রাত কাটান। আশ্রয়কেন্দ্রে যেতে রাজি নন, বলেন “সেখানে নিরাপদ না।”
তবুও তিনি একদিন বলেছিলেন, “আমি জানি আপনি আমার জন্য ভালো কিছু চান। একদিন সব ঠিক হবে।”
লেখক বিশ্বাস করেন—প্রত্যেক গৃহহীন মানুষেরই একটি ঘর পাওয়ার অধিকার আছে। তারা কোনো নায়ক না হলেও, মানবিক মর্যাদায় বাঁচার যোগ্য। খাবার, ঘুম, পরিচ্ছন্নতা—এসব মৌলিক চাহিদা পূরণের দায়িত্ব সমাজেরই।
লস অ্যাঞ্জেলেস কাউন্টিতে এখন প্রায় ৭৫,০০০ গৃহহীন মানুষ বসবাস করে। প্রত্যেকেই স্থায়ী আশ্রয় চায়।
এক অনুষ্ঠানে এক নারী, যিনি একসময় গৃহহীন ছিলেন, শিশুদের প্রশ্ন করেছিলেন—“তোমরা বড় হয়ে কী হতে চাও?” সবাই হাত তুলেছিল নানা পেশার জন্য। তারপর তিনি জিজ্ঞেস করেছিলেন—“তোমাদের কেউ কি গৃহহীন হতে চাও?”—নিঃশব্দ শ্রেণিকক্ষই উত্তর দিয়েছিল।
তার জীবন ভেঙে গিয়েছিল অসুস্থতা ও মানসিক বিপর্যয়ে। কিন্তু সামাজিক কর্মী ও চিকিৎসা সহযোগিতায় তিনি আবার ঘর ফিরে পেয়েছেন, এখন অন্যদের অনুপ্রেরণা দেন।
গৃহহীনতা প্রতিরোধের মূল উপায় হলো স্থায়ী আবাসন ও সহায়তা। যারা গৃহহীনদের নিজ এলাকায় আশ্রয়কেন্দ্র গড়তে আপত্তি করে, তারা বুঝতে চায় না—এই মানুষগুলোকে সরিয়ে দিলে তারা অদৃশ্য হয় না, শুধু অন্য এলাকায় ঠেলে দেওয়া হয়।
“গৃহহীনদের আবাসন” শব্দটাই বিভ্রান্তিকর। কারণ একবার কেউ ঘরে ঢুকে গেলে, সে আর গৃহহীন নয়। মানসিক সমস্যা বা দারিদ্র্য থাকলেও, অন্তত সে নিরাপদে ঘুমাতে পারে, গোসল করতে পারে, নিজের জিনিস রাখতে পারে।
লেখকের শেষ বার্তা স্পষ্ট—একটি সমাজ কখনোই সফল হতে পারে না যদি তার একাংশ দেয়ালের ভেতর আরেকাংশ রাস্তায় ঘুমায়। গৃহহীনদের জন্য ঘর মানে শুধু ছাদ নয়, সেটি নতুন জীবনের আশ্রয়।



