গাজা উপত্যকায় দুই বছরের ধারাবাহিক সংঘাত শান্ত করার লক্ষ্যে যুক্তরাষ্ট্রের প্রস্তাবিত একটি গুরুত্বপূর্ণ খসড়া অবশেষে জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদে গৃহীত হয়েছে। এ প্রস্তাবের মাধ্যমে গাজায় যুদ্ধবিরতি কার্যকর করা, বন্দিবিনিময় প্রক্রিয়া এগিয়ে নেওয়া এবং একটি আন্তর্জাতিক স্থিতিশীলতা বাহিনী গঠনের পথ আনুষ্ঠানিকভাবে উন্মুক্ত হলো। যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে প্রস্তাবটির পক্ষে ভোট পাওয়াকে সংশ্লিষ্ট পক্ষগুলো অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ বলে মনে করছে।
গাজা পরিস্থিতি স্বাভাবিক করার লক্ষ্য নিয়ে যে ২০ দফা পরিকল্পনা তৈরি করা হয়েছে, তার প্রথম ধাপে যুদ্ধবিরতি প্রতিষ্ঠা এবং ইসরায়েলি জিম্মিদের বদলে ফিলিস্তিনি বন্দিদের বিনিময়ের প্রক্রিয়ায় আগেই সম্মত হয়েছিল ইসরায়েল ও ফিলিস্তিনি সংগঠন হামাস। নিরাপত্তা পরিষদে গৃহীত নতুন প্রস্তাব মূলত এই পরিকল্পনাকে পরবর্তী ধাপে এগিয়ে নেওয়ার সুযোগ তৈরি করেছে।
প্রস্তাব অনুযায়ী, গাজায় একটি অন্তর্বর্তী প্রশাসন গঠনের অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। একে “বোর্ড অব পিস” নামে চিহ্নিত করা হয়েছে, যেখানে সদস্যরাষ্ট্রগুলো অংশ নিতে পারবে। এই আন্তঃদেশীয় কাঠামো উপত্যকার পুনর্গঠন, অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধার এবং সার্বিক প্রশাসনিক কার্যক্রম তদারকি করবে। পাশাপাশি গঠিত হবে একটি আন্তর্জাতিক স্থিতিশীলতা বাহিনী—যার দায়িত্ব হবে গাজায় নিরস্ত্রীকরণ নিশ্চিত করা, অস্ত্র জমা নেওয়া এবং সামরিক অবকাঠামো ধ্বংস করা।
তবে হামাস এ প্রস্তাবের বিরোধিতা করেছে। তাদের দাবি, তারা অস্ত্র ছাড়বে না, কারণ ইসরায়েলের বিরুদ্ধে তাদের লড়াইকে তারা বৈধ প্রতিরোধ হিসেবে মনে করে। সংগঠনের দেওয়া বিবৃতিতে বলা হয়েছে, এ প্রস্তাব গাজা উপত্যকার ওপর আন্তর্জাতিক অভিভাবকত্ব চাপিয়ে দিচ্ছে, যা গাজার জনগণ ও বিভিন্ন পক্ষ গ্রহণ করবে না। এ কারণে ভবিষ্যতে আন্তর্জাতিক স্থিতিশীলতা বাহিনীর সঙ্গে তাদের সংঘাত তৈরি হওয়ার আশঙ্কা থাকছে।
অন্যদিকে, নিরাপত্তা পরিষদে যুক্তরাষ্ট্রের স্থায়ী প্রতিনিধি জানান যে প্রস্তাবটি গাজায় একটি শান্ত রাজনৈতিক পরিকাঠামো গড়ে তোলার সুযোগ সৃষ্টি করবে এবং এটি ফিলিস্তিনিদের আত্মনিয়ন্ত্রণের পথে একটি সম্ভাব্য অগ্রগতি। তিনি আরও বলেন, প্রস্তাব কার্যকর হলে সন্ত্রাসমুক্ত, নিরাপদ এবং সমৃদ্ধ একটি গাজার দিকে এগিয়ে যাওয়া সম্ভব।
ভোটাভুটির আগে রাশিয়া প্রস্তাবটির বিরোধিতা করার ইঙ্গিত দিলেও শেষ পর্যন্ত ভোটদানে বিরত থাকে। চীনের প্রতিনিধি একইভাবে বিরত থাকেন। তাদের অভিযোগ—গাজা উপত্যকার ভবিষ্যৎ ব্যবস্থাপনায় জাতিসংঘের পরিষ্কার কোনো ভূমিকা এ প্রস্তাবে সংজ্ঞায়িত হয়নি। ভোটের পর রাশিয়ার পক্ষ থেকে জানানো হয়, প্রস্তাবের বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া এখনো অস্পষ্ট এবং এটি মূলত যুক্তরাষ্ট্রের পরিকল্পনার ওপর নির্ভরশীল।
অন্যদিকে, ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষ এ প্রস্তাবকে স্বাগত জানিয়েছে এবং তারা জানায় যে তারা বাস্তবায়ন প্রক্রিয়ায় অংশ নিতে প্রস্তুত। কূটনৈতিক সূত্র মতে, ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষের এই সমর্থনই রাশিয়ার ভেটো এড়ানোর অন্যতম কারণ হয়েছে।
প্রস্তাবে ভবিষ্যতের ফিলিস্তিন রাষ্ট্রগঠনের সম্ভাবনার কথাও উল্লেখ রয়েছে। এতে বলা হয়েছে, অন্তর্বর্তী প্রশাসন কার্যকরভাবে দায়িত্ব পালন করতে পারলে এবং গাজা পুনর্গঠনে অগ্রগতি এলে ফিলিস্তিনিদের আত্মনিয়ন্ত্রণ ও রাষ্ট্রগঠনের জন্য একটি বিশ্বাসযোগ্য পথ তৈরি হতে পারে। পাশাপাশি যুক্তরাষ্ট্র ইসরায়েল ও ফিলিস্তিন পক্ষের সঙ্গে রাজনৈতিক সংলাপও এগিয়ে নেবে।
এদিকে, ইসরায়েলের অভ্যন্তরে প্রস্তাবটি নিয়ে বিতর্ক সৃষ্টি হয়েছে। ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী ঘোষণা করেছেন যে দেশটি এখনো ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের ধারণার বিরোধী এবং গাজাকে যেকোনো উপায়ে নিরস্ত্রীকরণ করা হবে।
আন্তর্জাতিক পর্যায়ে এ প্রস্তাবকে অনেকেই শান্তি প্রতিষ্ঠার পথে একটি গুরুত্বপূর্ণ ধাপ হিসেবে দেখছেন, তবে এর বাস্তবায়ন কতটা সহজ হবে তা এখনো অনিশ্চিত।



