মসজিদে নামাজ শেষে বাসায় ফেরার পথে এক মোটরসাইকেলের ধাক্কায় মারাত্মক আহত হন নান্নু কাজী নামের এক ব্যক্তি। ঘটনার কয়েকদিন পর চিকিৎসাধীন অবস্থায় মৃত্যু হয় তাঁর। পরিবারের সদস্যরা জানতেন না, সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত বা আহত হলে ক্ষতিপূরণের আইন রয়েছে। ফলে নির্ধারিত সময়ের মধ্যে আবেদন করতে পারেননি তাঁরা। আইন অনুযায়ী দুর্ঘটনার ৩০ দিনের মধ্যে আবেদন করতে হয়, যার সময়সীমা তাদের ক্ষেত্রে ইতিমধ্যেই পেরিয়ে গেছে।
বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআরটিএ) তথ্য অনুযায়ী, দেশে ক্ষতিপূরণ ব্যবস্থা চালু হওয়ার পর থেকে নিহত ব্যক্তিদের পরিবারের মধ্যে মাত্র ৯ দশমিক ৮৬ শতাংশ ক্ষতিপূরণ পেয়েছেন। আহতদের মধ্যে এই হার আরও কম—মাত্র ১ দশমিক ৪২ শতাংশ। অথচ ক্ষতিপূরণ তহবিলে জমা আছে আড়াই শ কোটি টাকারও বেশি।
এই তহবিল গঠিত হয়েছে ২০১৮ সালের সড়ক পরিবহন আইনের আওতায়, যেখানে দুর্ঘটনায় নিহত বা আহতদের আর্থিক সহায়তার বিষয়টি স্পষ্টভাবে উল্লেখ আছে। ২০২২ সালের ডিসেম্বরে কার্যকর হওয়া বিধিমালা অনুযায়ী, নিহতের পরিবার পাবে ৫ লাখ টাকা, গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গহানির ক্ষেত্রে ৩ লাখ, স্থায়ী প্রতিবন্ধিতায় ৩ লাখ এবং আংশিক আহতের জন্য ১ লাখ টাকা ক্ষতিপূরণ।
তবে বাস্তবে এই অর্থ পেতে আবেদনকারীদের পড়তে হচ্ছে নানা প্রক্রিয়াগত জটিলতায়। দুর্ঘটনার পর শোকগ্রস্ত পরিবারের পক্ষে ৩০ দিনের মধ্যে প্রয়োজনীয় সব কাগজপত্র সংগ্রহ করা বেশ কঠিন। অনেক সময় উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ও জেলা প্রশাসকের অনুমোদনের দেরিতে পুরো প্রক্রিয়াই দীর্ঘায়িত হয়। ফলে অনেকেই ক্ষতিপূরণের সুযোগ থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন।
টাঙ্গাইলের এক দোকানদারের পরিবারও এমন ভুক্তভোগীদের মধ্যে অন্যতম। গত বছরের অক্টোবরে অটোরিকশা দুর্ঘটনায় মৃত্যুর পর তাঁর পরিবার আবেদন করলেও, এখনও পর্যন্ত কোনো সাড়া মেলেনি। জেলা প্রশাসন থেকে ফোন নম্বর নেওয়া হলেও পরবর্তী যোগাযোগ আর হয়নি।
ট্রাস্টি বোর্ডের দায়িত্বে থাকা বিআরটিএ সূত্রে জানা গেছে, ২০২৩ সালের অক্টোবর থেকে ২০২৫ সালের আগস্ট পর্যন্ত মোট ১,৬৬৮টি চেক বিতরণ করা হয়েছে—এর মধ্যে ১,৪০৫ জন নিহতের পরিবার ও ২৬৩ জন আহত ব্যক্তি সহায়তা পেয়েছেন। সব মিলিয়ে প্রায় ৭৪ কোটি ২২ লাখ টাকা বিতরণ করা হয়েছে। অথচ একই সময়কালে দেশে সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণ হারিয়েছেন প্রায় ১৪ হাজার ২৪৫ জন এবং আহত হয়েছেন ১৮ হাজার ৫৫৫ জন।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশে প্রতিবছর গড়ে ৩১ হাজারের বেশি মানুষ সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যায়। অথচ ক্ষতিপূরণ পায় অতি ক্ষুদ্র অংশ। সচেতনতার অভাব, প্রক্রিয়াগত জটিলতা ও প্রচারের সীমাবদ্ধতার কারণেই এই পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে বলে সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন।
বিআরটিএর চেয়ারম্যান জানিয়েছেন, ক্ষতিপূরণ প্রক্রিয়া ত্বরান্বিত করার জন্য জেলা প্রশাসনকে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে এবং টেলিভিশনে প্রচার চালানোর পরিকল্পনাও রয়েছে। বর্তমানে প্রায় ১২০টি নতুন চেক বিতরণের অপেক্ষায় আছে।
ট্রাস্টি বোর্ড সূত্রে জানা গেছে, তহবিলে এখনো ২৫৫ কোটি টাকার বেশি অর্থ অব্যবহৃত রয়েছে, যা দেশের বিভিন্ন পরিবহন মালিক ও সরকারের অনুদান থেকে সংগৃহীত। এই অর্থের একটি অংশ গবেষণা ও নিরাপদ সড়ক প্রচারণায় ব্যয় করার বিধান থাকলেও, এখনো তা কার্যকর হয়নি।
বিশেষজ্ঞদের মতে, ক্ষতিপূরণের প্রক্রিয়া আরও সহজ করা এবং স্থানীয় প্রশাসনকে সক্রিয় ভূমিকা নিতে হবে। দুর্ঘটনার পর স্বয়ংক্রিয়ভাবে আবেদন প্রক্রিয়া শুরু করা গেলে অনেক পরিবার আর্থিকভাবে সহায়তা পেতে পারে। এছাড়া ইউনিয়ন পর্যায় পর্যন্ত প্রচার বাড়ানোই হবে ন্যায্য অধিকার নিশ্চিত করার প্রথম ধাপ।



