কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার (AI) ব্যবহার শিক্ষাক্ষেত্রে এক নতুন মাত্রা যোগ করেছে। কিন্তু এর ইতিবাচক দিকের পাশাপাশি উঠে আসছে এক অস্বস্তিকর বাস্তবতা—শিক্ষক ও শিক্ষার্থীর মধ্যে আস্থার সংকট দিন দিন গভীর হচ্ছে।
সম্প্রতি এক মাধ্যমিক শ্রেণির শিক্ষার্থী ক্লাসে বসে লক্ষ্য করে যে, শিক্ষক “দায়িত্বশীলভাবে AI ব্যবহারের” গুরুত্ব নিয়ে আলোচনা করছেন। সেখানে বলা হচ্ছিল, শিক্ষার্থীরা চাইলে AI কে ভাবনার সহচর বা আইডিয়া বের করার টুল হিসেবে ব্যবহার করতে পারে। কিন্তু সেই সময়ই কিছু শিক্ষার্থী সরাসরি ল্যাপটপে বসে পুরো প্রবন্ধ তৈরি করতে ব্যস্ত। এই চিত্রই বর্তমান শিক্ষাব্যবস্থার একটি দিক তুলে ধরে—যেখানে শিক্ষার্থীরা AI কে কেবল কাজ সারার শর্টকাট হিসেবে নিচ্ছে।
শিক্ষার্থীদের একাংশ মনে করছে, AI ব্যবহারে কোনো নৈতিক দ্বন্দ্ব নেই। বরং এটি এমন এক টুল, যা ব্যবহার করে চিন্তার ঝামেলা ছাড়াই কাজ শেষ করা যায়। কিন্তু এতে বড় প্রশ্ন উঠছে—যদি শিক্ষার্থীরা নিজেরা চিন্তা করার প্রয়োজন বোধ না করে, তবে শিক্ষকের প্রতিক্রিয়া বা নির্দেশনা তাদের কাছে কতটা গুরুত্বপূর্ণ? অন্যদিকে শিক্ষকরা যখন অচলাবস্থায় থাকা AI ডিটেকশন সফটওয়্যারের ওপর ভরসা করতে বাধ্য হচ্ছেন, তখন তাদের সন্দেহও বাড়ছে। এই পারস্পরিক সন্দেহই শিক্ষার্থী-শিক্ষকের সম্পর্ককে নষ্ট করছে।
গবেষকরা বলছেন, এই পরিবর্তন কেবল পরীক্ষার ধরণ বা মূল্যায়নের কাঠামোতে নয়, বরং শেখার আসল উদ্দেশ্য ও শিক্ষকের ভূমিকা পুনর্বিবেচনার দিকে ঠেলে দিচ্ছে।
বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের গবেষণায় দেখা গেছে, শিক্ষার্থীরা অনেক সময় AI ব্যবহারের ক্ষেত্রে স্বচ্ছতার অভাব নিয়ে ক্ষুব্ধ হয়। যেখানে তাদেরকে ব্যবহারের প্রমাণ জমা দিতে বলা হয়, সেখানে শিক্ষকরা একই মানদণ্ড মেনে চলেন না। এর ফলে তৈরি হয় এক প্রকার “লো-ট্রাস্ট এনভায়রনমেন্ট”, যেখানে শিক্ষার্থীরা খোলামেলা ভাবে শেখার স্বাধীনতা হারায়।
এক গবেষণায় দেখা যায়, শিক্ষার্থীরা মনে করে শিক্ষকরা এখন তাদের ওপর কম আস্থা রাখছেন, বরং AI ডিটেকশন সফটওয়্যারের ওপর বেশি নির্ভর করছেন। এর ফলে শিক্ষার্থীরা “ডিফেন্সিভ” অবস্থায় কাজ জমা দেয়—যেন তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠতে পারে এই ভয়ে। এমনকি কেউ কেউ ভবিষ্যতে প্রমাণ রাখার জন্য স্ক্রিন রেকর্ড করার পরামর্শও দিয়েছে।
সবচেয়ে বড় সমস্যা হলো, এই ডিটেকশন সফটওয়্যার নির্ভরযোগ্য নয়। গবেষণায় প্রমাণ হয়েছে, বিশেষ করে ইংরেজি ভাষার অ-নেটিভ লেখকদের কাজকে প্রায়ই ভুলভাবে AI-জেনারেটেড হিসেবে শনাক্ত করা হয়। অন্যদিকে নেটিভ লেখকদের লেখা সহজেই পাস করে যায়। এর ফলে অনেক শিক্ষার্থী অন্যায়ভাবে অভিযুক্ত হচ্ছে এবং সম্পর্কের টানাপোড়েন আরও বাড়ছে।
এক ইংরেজি শিক্ষিকা বলেন, নতুন শিক্ষাবর্ষ শুরুর কয়েক সপ্তাহের মধ্যেই তাকে একাধিক শিক্ষার্থীকে AI ব্যবহারের কারণে সতর্ক করতে হয়েছে। তার মতে, “এটি এখন সম্পর্কের মধ্যে এক বিরাট দেয়াল তৈরি করছে। অথচ শিক্ষাবর্ষের শুরুতে আস্থা ও সম্পর্ক গড়ে তোলা সবচেয়ে জরুরি।”
সবমিলিয়ে, শিক্ষা ক্ষেত্রে AI এর প্রভাব ইতিবাচক হলেও শিক্ষার্থী-শিক্ষকের আস্থার ভিত্তি নড়বড়ে করে দিচ্ছে। শিক্ষা শুধু নম্বর তোলার প্রতিযোগিতা নয়, বরং শেখার প্রকৃত আনন্দ ও জ্ঞান অর্জনের প্রক্রিয়া। কিন্তু AI এর অপব্যবহারে সেটি ক্রমশ হারিয়ে যাচ্ছে।