কিডনি ও হৃদ্রোগ একে অপরের সঙ্গে গভীরভাবে জড়িত। চিকিৎসা বিজ্ঞানে এই সম্পর্ককে বলা হয় কার্ডিওরেনাল সিনড্রোম (সিআরএস)। বিশ্বব্যাপী ক্রনিক কিডনি ডিজিজ (সিকেডি) এবং কার্ডিওভাসকুলার ডিজিজ (সিভিডি) এখন মহামারির রূপ নিয়েছে। গবেষণায় দেখা যায়, কিডনি রোগীদের বড় অংশ হৃদ্রোগে আক্রান্ত হন এবং হৃদ্রোগীদের মধ্যেও কিডনি রোগের হার বেশি। বিশ্ব হার্ট দিবস উপলক্ষে জানা প্রয়োজন, কিডনি ও হৃদ্রোগের এ সম্পর্ক কতটা গভীর এবং প্রতিরোধে আমাদের করণীয় কী।
কেস স্টাডি ১
একজন অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক বহুদিন ধরে ডায়াবেটিস ও উচ্চ রক্তচাপে ভুগছিলেন। ধীরে ধীরে তাঁর হৃদ্যন্ত্র দুর্বল হয়ে পড়ে। হাঁটাহাঁটি বা সিঁড়ি ভাঙলেই শ্বাসকষ্ট দেখা দিত, পা ফুলে যেত। একদিন হঠাৎ শ্বাসকষ্ট বাড়লে হাসপাতালে ভর্তি করতে হয়। দুর্বল হৃদ্পিণ্ড পর্যাপ্ত রক্ত সরবরাহ করতে না পারায় কিডনিও ক্ষতিগ্রস্ত হয়। প্রস্রাব কমে গিয়ে শরীরে বিষাক্ত উপাদান জমে যায়। এভাবে হৃদ্রোগের প্রভাবে কিডনি বিকল হয়ে পড়ে।
কেস স্টাডি ২
একজন গৃহিণী দীর্ঘদিন ধরে কিডনি প্রদাহ ও উচ্চ রক্তচাপে ভুগছিলেন। ধীরে ধীরে তাঁর কিডনি কার্যক্ষমতা ৮৫ শতাংশ অকার্যকর হয়ে পড়ে। কিডনি শরীরের অতিরিক্ত পানি ও লবণ বের করতে না পারায় শরীরে পানি জমতে থাকে। এই চাপ হৃদ্যন্ত্রে প্রভাব ফেলে এবং রক্তশূন্যতার কারণে হৃদ্যন্ত্র দুর্বল হয়ে পড়ে। পরবর্তীতে তিনি হৃদ্রোগে আক্রান্ত হন।
বৈশ্বিক ও বাংলাদেশ পরিস্থিতি
বিশ্বজুড়ে প্রায় ৮৫ কোটি মানুষ কিডনি রোগে আক্রান্ত এবং প্রতিবছর কয়েক কোটি মানুষ হৃদ্রোগে মারা যাচ্ছেন। বাংলাদেশে সমীক্ষা বলছে, ১৬-২২ শতাংশ প্রাপ্তবয়স্ক মানুষ দীর্ঘস্থায়ী কিডনি রোগে ভোগেন, আর হৃদ্রোগ দেশে মৃত্যুর অন্যতম কারণ।
চিকিৎসা
ডায়ালাইসিস, কিডনি প্রতিস্থাপন কিংবা হার্ট সার্জারির মতো চিকিৎসা ব্যয়বহুল। তাই প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা গ্রহণই সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ।
সাধারণ ঝুঁকি কারণ
-
উচ্চ রক্তচাপ: কিডনি ও হৃদ্যন্ত্রের প্রধান ক্ষতিকারক।
-
ডায়াবেটিস: কিডনি ও হৃদ্রোগের বড় কারণ।
-
রক্তে চর্বি বৃদ্ধি (ডিসলিপিডেমিয়া): ধমনি শক্ত হয়ে যায়।
-
স্থূলতা ও মেটাবলিক সিনড্রোম: ওজন বাড়ার সঙ্গে ঝুঁকিও বাড়ে।
-
ধূমপান ও অ্যালকোহল: সরাসরি রক্তনালির ক্ষতি করে।
-
বংশগত কারণ ও বয়স: বয়স বাড়লে ঝুঁকি বেড়ে যায়।
-
দীর্ঘস্থায়ী প্রদাহ ও অক্সিডেটিভ স্ট্রেস: রক্তনালির ক্ষতি বাড়ায়।
হৃদ্পিণ্ড ও কিডনির পারস্পরিক প্রভাব
-
সোডিয়াম ও পানি জমা: কিডনি কাজ না করলে হৃদ্যন্ত্রে চাপ বাড়ে।
-
অ্যানিমিয়া: রক্তাল্পতায় হৃদ্যন্ত্র অতিরিক্ত কাজ করে।
-
ক্যালসিফিকেশন: ধমনিতে ক্যালসিয়াম জমে হার্ট অ্যাটাকের ঝুঁকি বাড়ায়।
-
হরমোন ও স্নায়ুতন্ত্র: উভয় রোগেই এসব সিস্টেম সক্রিয় থাকে, যা ক্ষতি ত্বরান্বিত করে।
প্রতিরোধের উপায়
-
প্রাথমিক শনাক্তকরণ: রক্তচাপ, শর্করা ও প্রস্রাব পরীক্ষার মাধ্যমে রোগ নির্ণয়।
-
ঝুঁকি নিয়ন্ত্রণ: চিনি, কোলেস্টেরল ও রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে রাখা।
-
জীবনধারার পরিবর্তন: কম লবণ, কম চর্বি, বেশি ফল-সবজি খাওয়া এবং নিয়মিত ব্যায়াম।
-
সমন্বিত চিকিৎসা: কিডনি ও হৃদ্রোগ বিশেষজ্ঞ একসঙ্গে কাজ করা।
-
রোগীর সচেতনতা: কিডনি রোগ মানেই হৃদ্রোগের ঝুঁকি বহুগুণে বাড়ে।
-
নীতিগত উদ্যোগ: সরকারি পর্যায়ে প্রতিরোধমূলক কর্মসূচি শক্তিশালী করা এবং চিকিৎসা সহজলভ্য করা।
শেষকথা
কিডনি ও হৃদ্রোগের সম্পর্ক এতটাই নিবিড় যে একটির চিকিৎসা আরেকটি ছাড়া সম্ভব নয়। এ কারণে দুই রোগকে একসঙ্গে প্রতিরোধ করাই একমাত্র কার্যকর সমাধান। সচেতনতা, নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষা ও জীবনধারার পরিবর্তনের মাধ্যমেই আমরা এ দুটি প্রাণঘাতী রোগ থেকে রক্ষা পেতে পারি।