পর্যটকদের আগ্রহ দিন দিন বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে এশিয়ার জনপ্রিয় পর্যটন স্থানগুলোতে ভিড় এবং অযাচিত আচরণের ঘটনা তীব্রভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে। ইতিহাসবাহী শহরগুলো এখন পর্যটকের চাপে ‘দম বন্ধ’ অবস্থায়, সমুদ্র সৈকতে হ্যান্ড-তাওয়েল, চেয়ার এবং ছাতা দিয়ে বালি দেখা প্রায় অসম্ভব হয়ে গেছে। এমনকি কেউ কেউ মদ্যপান ও বিশৃঙ্খল আচরণের কারণে পুলিশি নজরে আসছেন।
এটি ইউরোপের পরিচিত অতিরিক্ত পর্যটন সমস্যার সঙ্গে অনেকটা মিল রাখলেও, এখন এশিয়াতেও একই সমস্যা লক্ষ্য করা যাচ্ছে। বহু সুপরিচিত ভ্রমণ গন্তব্য পর্যটনের সীমারেখায় পৌঁছেছে, যা স্থানীয়দের জীবনযাত্রাকে প্রভাবিত করছে এবং ঐতিহ্যবাহী স্থানগুলোকে ধ্বংসের পথে ঠেলে দিচ্ছে।
কুয়ালালামপুর ভিত্তিক পর্যটন বিশেষজ্ঞের মতে, বালি এশিয়ার সবচেয়ে সমস্যাগ্রস্ত জায়গাগুলোর একটি। এছাড়া জাপানের কিয়োটো এবং থাইল্যান্ডের ফুকেটও অতিরিক্ত পর্যটনের কারণে সমস্যায় রয়েছে।
পর্যটকদের ভিড় এবং আচরণ কেবল জায়গার সীমাবদ্ধতার কারণে নয়। বিশাল এশিয়া মহাদেশে পর্যটন প্রভাব বিস্তার করলেও, সমস্যার মূল কারণ হলো একই গন্তব্যে একসাথে অতিরিক্ত মানুষ যাওয়া। কিয়োটোতে ভ্রমণ করা এক পর্যটক জানান, প্রখ্যাত ফুশিমি ইনারি শ্রাইনের জন্য সকাল ৫টায় উঠেও শেষ পর্যন্ত প্রচুর ভিড়ের মুখোমুখি হতে হয়েছে। শহরের সরু পথ, বাজার এবং গুরুত্বপূর্ণ ঐতিহাসিক স্থানগুলো পর্যটকের আনাগোনা ও সামাজিক আচরণের কারণে স্থানীয়দের জন্য চলাচল কঠিন হয়ে উঠেছে।
পর্যটন বৃদ্ধির মূল কারণ হিসেবে বিশেষজ্ঞরা উল্লেখ করেছেন কোভিড পরবর্তী চাপ মুক্তি, সস্তা বিমান ভাড়া, এশিয়ার মধ্যবিত্ত জনগোষ্ঠীর ভ্রমণ আগ্রহ, এবং বিভিন্ন দেশগুলোর আকর্ষণীয় প্রচারণা। স্থানীয় পর্যটনও বৃদ্ধি পাচ্ছে।
প্যাসিফিক এশিয়া ট্রাভেল অ্যাসোসিয়েশন (PATA) জানিয়েছে, এশিয়ায় পর্যটন কোভিডের পর দ্রুত পুনরুদ্ধার করেছে। ২০২৫ সালের প্রথম ছয় মাসে উত্তর-পূর্ব এশিয়া ২০% বৃদ্ধি দেখিয়েছে। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় ভিয়েতনাম বিশেষ করে দ্রুত বেড়েছে। হালং বে এবং হোয়ি আনসহ ভিয়েতনামের কিছু বিশ্ব ঐতিহ্য স্থান অতিরিক্ত ভ্রমণ ও ভিড়ের সমস্যায় পড়েছে।
থাইল্যান্ডে আন্তর্জাতিক পর্যটক সংখ্যা সামান্য কমলেও জনপ্রিয় স্থানে ভিড় অব্যাহত। ফুকেটে ট্রাফিক, পানি সংকট, বর্জ্য ব্যবস্থাপনা এবং ক্যানাবিস ব্যবহার নিয়ন্ত্রণের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। ফুকেটের কাছাকাছি দ্বীপ, যেমন ফি ফি দ্বীপের মায়া বে, এখনও ভ্রমণকারীর চাপে ভরা। পর্যটকরা একসাথে শতাধিক নৌকায় ভ্রমণ করেন, যার কারণে ছোট একটি স্টপও দীর্ঘ সময়ের যন্ত্রণায় পরিণত হয়।
পর্যটন অতিরিক্ত হলে স্থানীয় পরিবেশ ও সংস্কৃতি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। অনেক পর্যটন স্পটের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য হারাচ্ছে, এবং স্থানীয় জনজীবন ব্যাহত হচ্ছে। বিশেষজ্ঞরা উল্লেখ করেছেন, সৈকত ও দ্বীপগুলো সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ। বালিতে অতিরিক্ত নির্মাণ, রিসর্ট ও ভিলার কারণে পানির নিকাশ সমস্যা ও পরিবেশ বিপর্যয় ঘটেছে, যা বন্যা ও পরিবেশগত সমস্যাকে তীব্র করেছে।
ফিলিপাইনের বোরাকাইও অতিরিক্ত পর্যটনের শিকার হয়েছিল। ২০১৮ সালে ছয় মাসের জন্য পর্যটন বন্ধ করে পুনর্ব্যবস্থাপনা করা হয়। থাইল্যান্ডও মায়া বে’র জন্য সল্প সময়ের জন্য পর্যটন সীমিত করছে যাতে সমুদ্র ও তটরেখার পরিবেশ পুনরুদ্ধার হয়।
স্থানীয়দের জীবনযাত্রার ওপরও প্রভাব পড়েছে। কিয়োটোতে ২০২৪ সালে ৫৬ মিলিয়নের বেশি পর্যটক শহর ভ্রমণ করেছেন। স্থানীয়রা সরু পথ ও গণপরিবহনে ভিড়, অশ্লীল আচরণ এবং পর্যটকের দ্বারা সাংস্কৃতিক সংহতির ক্ষতি নিয়ে অসন্তুষ্ট। শহর কর্তৃপক্ষ নির্দিষ্ট এলাকায় পর্যটক প্রবেশ নিয়ন্ত্রণ ও জরিমানা প্রবর্তন করেছে, তবে পুরো সমাধান এখনও হয়নি।
পর্যটন বৃদ্ধির সঙ্গে অর্থনৈতিক সুবিধা বজায় রাখার জন্য দেশগুলো নানান প্রচেষ্টা চালাচ্ছে, কিন্তু আইন ও নিয়ম প্রয়োগে এখনও সীমাবদ্ধতা রয়েছে। অনেক সময় স্থানীয়দের স্বাচ্ছন্দ্য এবং পরিবেশ সুরক্ষার মধ্যে ভারসাম্য রক্ষা করা কঠিন হয়ে দাঁড়ায়।
যারা ভিড় এড়িয়ে শান্ত পরিবেশে ভ্রমণ করতে চান, তারা জনপ্রিয় স্থানগুলো ছাড়িয়ে নতুন জায়গা অন্বেষণ করতে পারেন। স্থানীয়দের সাথে কথা বলে কম পরিচিত স্থানগুলো খুঁজে বের করাও এক সুখকর অভিজ্ঞতা হতে পারে।



