পৃথিবীর বুকে এমন এক শহর রয়েছে, যেখানে প্রায় পুরো জনপদটি বাস করে একটি মাত্র ভবনের ভেতরে। যুক্তরাষ্ট্রের আলাস্কার প্রত্যন্ত অঞ্চলে অবস্থিত এই শহরের নাম হুইটিয়ার। শহরটির কেন্দ্রবিন্দুতে দাঁড়িয়ে আছে ১৪ তলা বিশাল ভবন বেগিচ টাওয়ার্স। এখানেই বসবাস করেন শহরের প্রায় সব মানুষ। প্রশাসন, স্বাস্থ্যসেবা, কেনাকাটা, ধর্মীয় কার্যক্রম থেকে শুরু করে দৈনন্দিন জীবনের প্রায় সব প্রয়োজনই পূরণ হয় এই এক ছাদের নিচে।
আলাস্কার এই শহরটি বাইরের জগৎ থেকে অনেকটাই বিচ্ছিন্ন। এখানকার জীবনধারা কল্পনা করলেই বোঝা যায়, কেন একে পৃথিবীর অন্যতম অদ্ভুত শহর বলা হয়। সকালে ঘুম থেকে উঠে চা বানাতে গিয়ে যদি ঘরে কোনো প্রয়োজনীয় জিনিস না থাকে, তবে বাইরে যেতে হয় না। লিফটে করে নিচে নামলেই দোকান। কেনাকাটা শেষে আবার একই লিফটে দেখা হয়ে যেতে পারে শহরের গুরুত্বপূর্ণ কোনো কর্মকর্তার সঙ্গে। এই শহরে এমন দৃশ্য একেবারেই স্বাভাবিক।
শিশুদের স্কুলে নেওয়ার ক্ষেত্রেও বাইরে বেরোতে হয় না। বেগিচ টাওয়ার্সের সঙ্গে সংযুক্ত রয়েছে একটি সুড়ঙ্গ, যা সরাসরি স্কুলে গিয়ে মিশেছে। বাইরে তীব্র তুষারঝড় কিংবা প্রচণ্ড ঠান্ডা থাকলেও শিক্ষার্থীদের গায়ে বাতাস লাগে না। এটি কোনো কল্পবিজ্ঞানভিত্তিক গল্প নয়, বরং হুইটিয়ারের প্রতিদিনের বাস্তবতা।
এই শহরে প্রবেশ করাও সহজ নয়। পাহাড়ের নিচ দিয়ে চলে যাওয়া প্রায় চার কিলোমিটার দীর্ঘ একটি সুড়ঙ্গই বাইরের দুনিয়ার সঙ্গে এর প্রধান স্থলসংযোগ। সুড়ঙ্গটি এতটাই সরু যে একসঙ্গে দুটি গাড়ি চলাচল করতে পারে না। একই পথ দিয়ে আবার রেললাইনও ব্যবহার করা হয়। নির্দিষ্ট সময় অনুযায়ী কখনো গাড়ি, কখনো ট্রেন চলাচল করে। রাত দশটার পর এই সুড়ঙ্গ বন্ধ হয়ে যায়। সময়মতো শহরে ঢুকতে না পারলে বাইরে অপেক্ষা করা ছাড়া কোনো উপায় থাকে না।
শহরে ঢুকতেই চোখে পড়ে পাহাড়, হিমবাহ আর সমুদ্রের অপূর্ব দৃশ্য। এই প্রাকৃতিক পরিবেশের মাঝখানে একাকী দাঁড়িয়ে থাকে বেগিচ টাওয়ার্স। বাইরে থেকে ভবনটি পুরোনো মনে হলেও ভেতরে ঢুকলে ভিন্ন চিত্র দেখা যায়। এটি মূলত একটি স্বয়ংসম্পূর্ণ ছোট শহর।
বেগিচ টাওয়ার্সে রয়েছে শহরের একমাত্র পুলিশ স্টেশন। কোনো ঘটনায় পুলিশকে দূরে যেতে হয় না, লিফটেই কাজ সারা যায়। ডাকঘর, মুদিদোকান, লন্ড্রি, প্রাথমিক চিকিৎসাকেন্দ্র এবং গির্জাও রয়েছে একই ভবনে। পর্যটকদের জন্য ওপরের তলাগুলোয় রয়েছে আবাসনের ব্যবস্থা। ফলে বাসিন্দা ও অতিথি উভয়ের প্রয়োজনই পূরণ হয় এক জায়গায়।
হুইটিয়ারের মোট জনসংখ্যা ঋতুভেদে দুই থেকে তিনশর মধ্যে ওঠানামা করে। এই অল্পসংখ্যক মানুষের প্রায় সবাই এই ভবনেই বসবাস করেন। স্থানীয়দের কাছে ভবনটি পরিচিত একটি সংক্ষিপ্ত নামেও।
এই অদ্ভুত বসবাস ব্যবস্থার পেছনে রয়েছে ইতিহাস। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ ও শীতল যুদ্ধের সময় এই অঞ্চলকে কৌশলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ মনে করে এখানে সামরিক স্থাপনা গড়ে তোলা হয়। সৈন্যদের থাকার জন্য বড় আকারের ভবন নির্মাণ করা হয়েছিল। পরবর্তীতে সামরিক বাহিনী চলে গেলে সাধারণ মানুষ এই মজবুত ভবনটিকে নিজেদের বসবাসের উপযোগী করে নেয়।
এখানকার আবহাওয়া এতটাই কঠিন যে আলাদা আলাদা বাড়িতে থাকা প্রায় অসম্ভব। বছরে বিপুল পরিমাণ তুষারপাত হয় এবং শীতকালে বাতাসের গতি অত্যন্ত বেশি থাকে। এই পরিস্থিতিতে এক ভবনের ভেতরে থাকা তুলনামূলক নিরাপদ, সাশ্রয়ী ও আরামদায়ক। পুরু দেয়াল ও শক্ত কাঠামো বাসিন্দাদের তীব্র ঠান্ডা থেকে রক্ষা করে।
এই শহরের সামাজিক জীবনও আলাদা। সবাই সবাইকে চেনে। ব্যক্তিগত গোপনীয়তা কম হলেও পারস্পরিক সহায়তা অত্যন্ত দৃঢ়। কেউ অসুস্থ হলে বা বিপদে পড়লে প্রতিবেশীরা এগিয়ে আসেন। শিশুরা করিডোরে খেলাধুলা করে এবং পুরো ভবনটিই যেন একটি বড় পরিবারে রূপ নেয়।
আয়ের ক্ষেত্রেও বাসিন্দারা পিছিয়ে নন। সমুদ্রবন্দর, রেলওয়ে, মৎস্য আহরণ এবং পর্যটন এখানকার প্রধান আয়ের উৎস। গরমকালে হাজার হাজার পর্যটক এই শহরে আসেন। তখন স্থানীয়রা বিভিন্ন সেবামূলক কাজে যুক্ত হন। শীতকালেও শহর পরিচালনার জন্য প্রয়োজনীয় সব কাজ চলতে থাকে।
বেগিচ টাওয়ার্স শুধু একটি ভবন নয়, এটি মানুষের অভিযোজন ক্ষমতা ও একসঙ্গে টিকে থাকার শক্তির প্রতীক। প্রকৃতির কঠোর পরিবেশের সঙ্গে লড়াই করে এখানে মানুষ গড়ে তুলেছে এক অনন্য জীবনব্যবস্থা, যা পৃথিবীর আর কোথাও খুব কমই দেখা যায়।



